সম্প্রতি হয়ে গেল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। একবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া এটিই প্রথম সুপার ঘূর্র্ণিঝড়। ‘আম্পান’ একটি থাই শব্দ যার অর্থ আকাশ। ২০০৪ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের নামকরণ প্রস্তাব করেছিল থাইল্যান্ড। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার পর এটি সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড়। উপকূলীয় মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে। যখন কোন বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তখন জীবন ও জীবিকার জন্য তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়। জীবন বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিতে হয় নিরাপদ স্থানে। আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে প্রতিবন্ধী, নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের অনেক কষ্ট করতে হয়। যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই প্রতিবন্ধী, নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরে চিরচেনা নিজের বাড়িটিও অচেনা মনে হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সাথে অনেকের বাঁচার স্বপ্নও বাতাসে উড়ে যায়। মাথা গোঁজার মত আশ্রয়টুকুও থাকে না।
তবে আম্পানের আঘাত শুধু উপকূলীয় এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। যারা ঘূর্ণিঝড়ের সাথে তেমন পরিচিত নন এবং ঘূর্ণিঝড়ের জন্য যাদের কোন প্রস্ততি থাকে না আম্পানের ছোবল থেকে সেই মানুষগুলোও বাদ পড়েনি। যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়াতেও আম্পানের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়েগেছে অনেক ঘরবাড়ি, পশুপাখি, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসল। উপকূলীয় জেলা না হয়েও আম্পানে সবচেয়ে বেশি ১২ জন লোক মারা গেছে যশোর জেলায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার মাধমে আমরা দেখেছি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে মহাবিপদ সংকেত দেখানোর পর উপকূলবর্তী এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন এবং সিপিপিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকরা করোনায় মধ্যে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করতে ও নিরাপদস্থানে যেতে প্রশংসনীয় ভুমিকা পালন করেছেন। ঘূর্র্ণিঝড় আম্পানের পর উপকূলবর্তী এলাকায় বেড়িবাঁধ মেরামত করতে দলমত নির্বিশেষে কাজ করছেন।
খুলনা জেলার কয়রা উপজেলায় বর্তমান সময়ে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে যেখানে অত্র এলাকার মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ভেদাভেদ ভুলে বাঁধ নির্মাণের কাজ করেছেন এবং পানির মধ্যে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সামাজিক ঐক্য এবং নিজেদের সমস্যা নিজেরাই মোকাবিলা করার অভ্যাস গড়ে তোলা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা দেখেছি, ঈদের নামাজের ইমামতি করেছেন কয়রা উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দিন যিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। ঈদের নামাজের তাকবীর দিয়েছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এস এস শফিকুল ইসলাম। এরকম দৃশ্য বর্তমান সময়ে সচরাচর দেখা যায় না।
ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় উপকূলীয় এলাকায় অনেক বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতার কারণে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও নির্মাণ বা সংস্কার হয়নি অনেক বেড়িবাঁধ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কয়রা উপজেলার মোট ১১৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে সাড়ে চার কিলোমিটার পুরোপুরি ভেঙ্গেগেছে এবং ৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙ্গে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়রা উপজেলার ৪৭ গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, শ্যামনগর উপজেলার ১৫,৫১২টি ঘরবাড়ি এবং ১.৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’ আম্পানের আঘাতে বরগুনার ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং সাড়ে ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েগেছে। পিরোজপুরে আম্পানের আঘাতে প্রায় আড়াই হাজার ঘরবাড়ি ও ১৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বাগেরহাটে আম্পানের আঘাতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে।
আম্পানের আঘাতে বেড়িবাঁধ মেরামত করতে স্থানীয় জনগণ ও বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম যেমন মানুষের নজর কেড়েছে ঠিক তেমনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভুমিকা মানুষকে হতাশ করেছে। পাশাপাশি তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কতিপয় স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের গাফিলতির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জনগণের রোষানলে পড়তে হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে তা স্থানীয় যুবকদের দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা জনমিতিক লভ্যাংশ বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছি। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম এবং যার অর্ধেকের বেশি ৩৫ শতাংশ যুবক-যুবতী। এই যুবক-যুবতীদের আমরা যদি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমরা যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখি সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে করোনার মতো মহামারির মধ্যেও উপকূলবর্তী এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি যুবকরা যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং এখনও নিরলসভাবে কাজ করছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। আমাদের এসব যুবকদের ভালো কাজে উৎসাহিত করতে হবে এবং দেশের কল্যাণে তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দলমত নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।