আমরা যে লেখাটি লিখতে চাচ্ছি, তা একজন কবির একটি গ্রন্থ পাঠ পরবর্তী আলোচনা। সেই গ্রন্থে প্রবেশের আগে আমরা আধুনিক/অনাধুনিক নিয়ে কথা বলতে চাইছি। রবীন্দ্রনাথঠাকুর আধুনিক কবি ছিলেন নাকি ছিলেন না, এ বিষয় নিয়ে এক শতাব্দীকালব্যাপী গবেষকবৃন্দ, প্রাবন্ধিকগণ আলোচনা/ সমালোচনামূলক লেখা লিখেছেন। ত্রিশের আধুনিকতাবাদী কবি সমাজ ইউরোপীয় সাহিত্যের যে জোয়ার বাংলা কবিতায় প্রবেশ করালেন এবং আমরা আধুনিক কবিতার একটা সম্যক চারিত্রিক দিক পেলাম, সেই শুরু। তাহলে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল? এ বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রবাহমান নদীর স্রোতের মতো রবীন্দ্র সাহিত্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। কোথাও স্থির হয়ে নেই, অথচ সেই একই নদী। রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতা বলতে বিশেষ একটি মেজাজ বুঝতেন। সময়ের দিক থেকে তার বিচার করতে চাননি। সাহিত্যের গতি পরিবর্তনকে তিনি নদীর বাঁকের এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। “রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ থেকেই আধুনিকতার শুরু” -এমন মন্তব্যও সাহিত্য বোদ্ধারা করেছেন। আমরা একটি আধুনিক কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলতে চাইছি। তাই আধুনিক যুগের বিষয়টাও একটু আলোচনা করা দরকার ছিল। একজন কবিকে জানতে হলে শুধুমাত্র চেতনার জগতে জানলে চলবে না, কবির অবচেতন সম্বন্ধে ও ধারণা নিতে হবে। তাহলে আমাদের কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশে সুবিধা হবে।
‘অপঠিত জলপাইলিপি’। কবি শান্তিময় মুখোপাধ্যায়। বাংলা কবিতায় কোলকাতার আশির দশকের কবি। উত্তরাধুনিক কবি। শান্তিময় মুখোপাধ্যায় জীবনানন্দ দাশের উত্থান পর্বের পঞ্চাশ বছর পরের কবি। আবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, আল মাহমুদের ত্রিশ বছর পরের কবি। সৌন্দর্যের উপলব্ধি, প্রেমের বিশ্বব্যাপীচেতনা, মনুষ্যত্ববোধ ও সামাজিক মূল্য চিন্তার পরিপূর্ণ ধ্যান-ধারণা আমরা শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় তালাশ করবো। রবীন্দ্রউত্তর বাংলা কবিতায় ত্রিশের আধুনিক মশালের আলোর রেশ আশির, নব্বইয়ের এমনকি প্রথমদশক পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানে শনাক্তের প্রশ্ন আসে। আমরা আল মাহমুদের জাত চিনেছি ‘সোনালি কাবিন’ এ। বিনয় মজুমদারকে ‘ফিরে এসো চাকা’। তাহলে এসময়ের কিংবা আশির দশকের শনাক্ত চিহ্ন কি? ঝাঁকে ঝাঁকে কবি যশোপ্রার্থীরা কবিতা লিখেছেন, লিখছেন, লিখবেন। গতানুগতিক ধারায় সবাইকেই প্রায় ছায়াছবি মনে হয়, কেউ কেউ ছাড়া। জীবনানন্দ দাশ যেভাবে বলেছেন, ‘সকলেই কবি না, কেউ কেউ কবি’। ত্রিশের দশকে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে তিনি অসংখ্যবার অসংখ্য সাহিত্য বাসরীয় সভায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তাঁর সময়ে তাঁর কবিতার ভাষা সকলেই বোঝেননি, কেউ কেউ বুঝেছেন। তিনি যে তাঁর সময়ের চেয়ে শত বছর সামনে দেখতে পাচ্ছেন এবং সে চিন্তায়, চেতনায়, মননে লিখে চলেছেন, তাঁর সময়ে অনেকেই তা বোঝেনি। অগ্রসর চিন্তাও নতুন শব্দ সমারোহ ঘটিয়ে যাঁরা এগোচ্ছেন, আগামীদিনে বাংলা কবিতার কাপ্তান-ই-দরিয়া তারাই হবেন, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। শান্তিময় মুখোপাধ্যায় নিভৃতচারী কবি। আমূল পরিবর্তনে তিনি কাজ করছেন। বাংলা কবিতায় চিন্তার জগতে নতুন কিছু ইতোমধ্যে সংযোজন করে ফেলেছেন। আমরা তাঁর কবিতার প্যাটার্নে বিবর্তন ও গভীর হৃদয়াবেগের সঙ্গে পরিচিত হই। আমরা চমকে উঠি তাঁর বাক্য বিন্যাস ও শব্দ চয়নের ঠাসবুনটে। ‘অপঠিত জলপাইলিপি’ থেকে তিনটি কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘কালপুরুষ’, ‘বিষধর্ম’, ‘মাংসতন্ত্র’, ‘বিষণ্ণ পদাবলী’ এই চারটি পর্বে ভাগ করা থেকে আমরা কালপুরুষ থেকে শুরু করছি।
১) ইকো ফ্রেন্ডশিপ ভেঙে তোর চলে যাওয়া
রুম টেম্পারেচারে রেখে গেলে মৃদু কুরুশের নখর ভ্রমণ
কুয়াশাপাগল দাম্পত্য শরীরে লেগে থাকা পশমগন্ধ
আমলকি রেণু মেখে তাহলে কি আর কোনভাবে
উড়ে যেতে চাইছে না করতলময় ঝুঁকিগুলোর দিকে
সাইবার আলোয় নুয়ে পড়া রাতজাগানিয়া আনায়াসে তুমি
পড়ে নিতে পারো এই স্বেচ্ছা অবসরের অন্ত্যমিল
(দূষণ, পৃষ্ঠা-১৩)
২) ভুল বিড় ছিল ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফ্যাকাশে সরগম
নইলে সপ্তপর্ণী কিভাবে মিশে যায় ছায়ার অলিন্দে
ছেঁড়া কথা, ডাঁটিভাঙা ওড়ানো গুজব
একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে অন্ধপ্রথামতো
পারদ প্রহরা ভেঙে সান্ধ্যকালীন রাগ সে সময়
বেজে ওঠে বেহুঁশ অর্গান
অলস বাতিদান কাঁপে তিরতির মোমকুঠুরিতে
মূক অপেরায়, একা
(অনুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫)
৩) রানওয়ের ইস্তেহারে চৌরাস্তার গল্প লিখে গেছে কেউ
বৃষ্টি তাঁবুতে কুন্ডলী পাকিয়ে আমরাও লিখে নিছি
কয়েক মিনিট নীরবতা
অহিংস রেপ্লিকার পায়ে চাপা পড়ে থাকা কঙ্কাল অতীত ভেজাচ্ছে
আর মোরামের নায়াগ্রার ভিখিরিকাতর অন্ত্যোদয়
একান্নবর্তী সকাল জানে
দরকষাকষি দিয়ে শুরু হওয়া মিডিয়ার রক্তপাত।
(ছায়াচরাচর, পৃষ্ঠ-১৮)
আমরা তিনটি কবিতার রেফারেন্স দিয়েছি। আধুনিক কবিতার শরীর দশকের বিবর্তনে কোথায় উপনিত হয়েছে, আমরা তা বোঝাতে চাচ্ছি। চিত্রকল্প ও শব্দ প্রয়োগে শান্তিময় মুখোপাধ্যায় ত্রিশের আধুনিকতার দিকে নজর রেখেই একটা নতুন পথ নির্মাণ সচেষ্ট হচ্ছেন। শান্তিময় একটা নিজস্ব গত্যন্তর নির্দেশ করছেন পাঠক সমাজকে। যা তাঁর একান্তই নিজের। এখানেই তাঁকে আলাদা মনে হয়। ‘দূষণ’ কবিতায় চিত্রকল্পে নতুনত্ব আছে। শব্দ প্রয়োগে সাম্প্রতিক ব্যবহৃত শব্দে ঝুঁকলেও তিনি বেশ সচেতন। ‘সাইবার আলোয় নুয়ে পড়া পাত জাগানিয়া অনায়াসে তুমি/পড়ে নিতে পার এই স্বেচ্ছা অবসরে অন্তমিল”-। মাঠভাঙা আলপথ নয় কবি বেছে নিলেন ‘সাইবার আলো’। পৃথিবীকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেষ্টনি করে আছে যা এই মুহূর্তে। এখানে শান্তিময়ের কাব্যদর্শন একটা ইংগিত দিচ্ছে আমাদের। বিশেষ কেউ একজনকে একটা সহিষ্ণু সময় পাঠ করার আহবান একটা চিত্রের মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় কিছুটা আলো আর কিছুটা আঁধারের তত্ত্বে। আমরা জানি, পৃথিবীতে সুন্দর ও কুৎসিত পাশাপাশি বসবাস করে। বিকাশ ও চরম পরিণতির নতুন স্বাদ আনতে গেলে নতুন ঝাঁঝ দরকার। কবি সে কাজটিই করেছেন। নতুন কবিতা ভাবনায় তিনি আমাদের নতুন আনন্দে মশগুল রাখার পরিবর্তিত পৃথিবীর দিকে এগিয়ে দেন। দীর্ঘদিন একটা কাব্য ধারার প্রচলন চলে আসছে। নতুন ভাবে চেনা যাচ্ছেনা। সবাই কবিতা লিখছেন, ভালো কবিতা। কিন্তু শব্দ প্রয়োগ আর চিন্তায় নতুন ঝাঁঝ না থাকায় প্রায় সব কবিতাই একই রকম মনে হয়। এখানেই শান্তিময় মুখোপাধ্যায় আলাদা হওয়ার রাস্তা খুঁজেছেন। জোৎস্নার সৌন্দর্য অন্যভাবে উপভোগ করতে চান। ভাব, ভাষা, অনুষঙ্গে তিনি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর নির্মাণে একাগ্রতায় এগিয়ে যাচ্ছেন।
‘কালপুরুষ’ থেকে এবার আমরা ‘বিষধর্ম’ পর্বে প্রবেশ করছি। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি অন্যান্য বিষয়ের মতো প্রেমের ব্যাপারেও আমাদের চিন্তা-চেতনা ও শব্দে এনেছে নতুনত্ব। ফলে আমাদের মানসিক জটিলতা বেড়েছে। তাছাড়া একথাও বলা যায় চিরায়ত প্রেমের ভাষায় কবিতা যেভাবে লেখা হতো আগে এখন সেখানে শব্দের এক চমকিত পরিবর্তন এসেছে। পুরানো চিন্তাধারা বুদ্ধির পথে রক্তের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তার নাম সংস্কার। সে সংস্কারকে মানুষের জীবন থেকে একেবারে নির্মূল করে ফেলা যায়না। ফলে সংঘর্ষ লাগে হৃদয় ও মস্তিষ্কের। বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত মানবাত্বার পরিচয় যদিও চিরকালের কবিতার প্রানবন্ত, তবুও আধুনিককালে জ্ঞানের ক্ষেত্রে, নানা নতুন আবিষ্কার ও অভিনব অভিজ্ঞতার ফলে জীবনের ক্রমবর্ধমান জটিলতার জন্যই বর্তমানে তা ব্যাপক মর্যাদা লাভ করেছে শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের কবিতায়। তাঁর মনোভঙির যে আত্মপ্রকাশ অর্থাৎ যাকে আমরা বলি অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি। যুগ যতোই আত্মপ্রকাশ করুক নতুন ঢঙে সেখানে কবি প্রতিভার অলৌকিকত্ব-কে এমনভাবে শান্তিময় মুখোপাধ্যায় নির্মাণ করেছেন তাঁর কবিতায়, যা পাঠে আমরা বিস্মিত। ‘বিষধর্ম’ পর্বে যুগচিন্তা, প্রেম, প্রকৃতির যে চিত্রায়ন তিনি করেছেন তা সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সে কারণেই আশির দশকে বাংলা কবিতায় যে কজন খ্যাতি লাভ করেছেন, শান্তিময় মুখোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট একটি নাম। স্বতন্ত্র ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন বলে তাকে খুব সহজেই আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়। ইংরেজি শব্দ বাংলা কবিতায় দারুণ দক্ষতার সঙ্গে প্রবেশ করিয়েছেন তিনি। মাল্টিপ্লেক্স, সাইবার, হোয়ার হ্যাভ মাই ওয়েভস গান, অ্যালবাম, সেভেন-আপ, ল্যান্ডস্কেপ, পিক্সেল, প্রোফাইল, ডেলিরিয়াম, মেগাবাইট, সেলফি, আপলোড, সেক্সিটাচ, সফটওয়ার, ফোরজি, সিস্টোলিক, সিকোয়েন্স, সাইলেন্সমোডে, ফটোগ্রাফ, ফ্লেমোরিয়া, মিউট, ক্লিপিং, ব্রেসলেট, রিংটোন, ‘বিষধর্ম’ পর্বেই এতগুলো ইংরেজি শব্দ চমৎকারভাবে কবিতার শরিরে লেপ্টে আছে। যা পাঠে আমাদের চিন্তার ঘ্রানে নতুন সুখানুভূতি দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, এশব্দগুলো বাংলাভাষার শব্দ। সাম্প্রতিক এ্যান্ড্রোয়েড জামানায় আমরা আছি। ইন্টারনেটের কল্যাণে এ শব্দগুলো আমাদের পাশের বাড়ির মেহমান মনে হয়না, মনে হয় আঙিনায় মাদুর পেতে বসে থাকা খেলারত সেই শিশু যার জন্মকাল পাঁচ বছর। এই শব্দগুলোকে এমন আমাদেরই শিশু মনে হয় অর্থাৎ আমরা বলতে চাচ্ছি, ইংরেজি এ শব্দগুলোর বহুল প্রচলনে একদিন হয়ত এগুলো বাংলা শব্দ হিসেবে বিবেচিত হবে। মানুষের জীবন থেকে প্রকৃতিকে বাদ দিলে জীবন যেমন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, জ্ঞান থেকে প্রেম বর্জন করলে খন্ডিত হয় জীবন, তেমনি মানবসভ্যতার ক্রমঅগ্রসরমান জীবনে যাপিত সময়ে ব্যবহৃত শব্দরাতি প্রচলিত নিয়মের মধ্যে দিয়ে কবিতার শরীরে স্থান পেলে তা দৃষ্টিনন্দন হয়।
১) ভোরের হলুদ রোডে বেজে উঠবে বিদায় বেলার সারিগান
অপাপবিদ্ধ হাঁসেরা মাল্টিপ্লেক্সের দিকে উড়ে যেতে যেতে
কান্নায় ভেঙে পড়বে অনির্বচনীয় কোন গন্তব্যের নিচে
(সমর্পণ, পৃষ্ঠা-২৫)
২) কতখানি নির্জনতার পাশে বসলে শুন্য ঝুলতে থাকে
দুলে দুলে মিশে যায় রোপওয়ের অন্ধকার পাদানির তলায়
রোজভ্যালির এলিট ঘাসবন তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি
হোয়ার হ্যাভ মাই ওয়েভস গান
(মৎস্যপূরাণ বালিয়াড়ি, পৃষ্ঠা-২৭)
৩) ল্যান্ডস্কেপের মৃদু শিথিলতাও
পিক্সেলে তোমার ছবি বলতে এই লুকিয়ে দেখার প্রোফাইল
ডেলিরিয়ামের উৎরাই ভেড়ে অন্যমনস্ক
(সিম্ফনি, পৃষ্ঠা-৩০)
৪) শরীরের অ্যাপস-এ যতগুলো সেক্সিটাচ আর খোলাচুল
লাজুক অববাহিকা এখন ওড়নাবিহীন সফটওয়্যার
স্টপেজের নশ্বরগুলো মুছে দিচ্ছে ৪এ-র ভোডাফোনে
(মুঠোসভ্যতা, পৃষ্ঠা-৩১)
৫) সমুদ্র মিউট রেখেই সেলফি তুলছে ঢেউগুলো
পায়ের পাতাও ক্রমশ ফসকে যাচ্ছে নুন থেকে
পুরনো চটির অছিলায় জল ফিরিয়ে দিল পা
কিছু ক্লিপিংস তুলে রেখে ঝাপসা লেন্স
লোনা হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়েই চলেছে
(মেমোরি বাইট, পৃষ্ঠা – ৩৫)
প্রত্যেক কবিতার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শান্তিময় মুখোপাধ্যায় ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। এটা কবির নিরীক্ষা প্রবণ কাজ। পোস্ট মডার্ণ কবিতার ঐশ্বর্য দারুণ নতুনত্বের মধ্যে দিয়ে আমরা কবির কবিতার মধ্যে খুঁজে পাই। একদিকে ইংরেজি শব্দের নিরীক্ষা প্রবণতা অন্যদিকে তাঁর কবিতায় পোস্ট মডার্ণ প্যাটার্নে রয়েছে উপমায় নতুনত্ব। আমরা ‘মাংসতন্ত্র’ ও ‘বিষন্ন পদাবলী’ তে প্রবেশ করলে উপরের বয়ানের, যথার্থতা খুঁজে পাই। আমরা শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের দুটি উদাহরণ লক্ষ্য করি:
১) উৎরাই বালিয়াড়ি সুখ যেন নরম
কাপড়ে মোরা নীল পাড়
নৌকা ভাসিয়ে দূরে জলখোঁজ গুঁজে দেয়
হাওয়ামোরগের ঝুঁটিতে
অন্ধ সারেঙ্গের বাঁশিতে চাঁদ ঝরে পড়ল
টুপটাপ, কলঙ্ক মাখান
(মাংসতন্ত্র, পৃষ্ঠা-৫০)
২) মেলে দেওয়া শাড়িটার সাথে তোমার শরীরগন্ধ আকাশের দিকে
উড়ে যেতে আমরা ঘন হয়ে উঠল বর্ষণ মুখরতা
মেঘ রচিত পঙক্তিমালা যা পোস্ট করেছিলে শ্রাবণ সন্ধ্যায়
অঝোর ঝরালো সাহস পাখিদের জানায়
দীর্ঘ বুননে ঠাসা ভালোবাসাবাসি তার পাখসাটে
কোথায় যে হারালো কেউ-ই জানলো না।
(কুহক, পৃষ্ঠা-৫৯)
চির নতুনের ডাক। কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের সৌরজগতের বাহিরে গিয়ে শব্দে, ভাষায় যে চমক ও পরিবর্তন নিয়ে আসেন তাঁর পরম্পরায় ত্রিশের আধুনিকতাবাদী কবি সমাজ দুঃসাহসিক কাজ করেন। কিন্তু শুরুতে বলতে চেয়েছি রবীন্দ্রনাথ কি আধুনিক কবি? যা নিয়ে গবেষক, প্রাবন্ধিকরা আজো লিখে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল সূর্যকে পাশ কাটিয়ে পথ চলা দুঃসাধ্য কাজ। যা ত্রিশের দশক থেকে শুরু হয়। পরবর্তী দশকের কবিরা নজরুল, জীবনানন্দে ডুবে থাকেন। এরপর যত সময় গড়িয়েছে, আধুনিক কবিরা বারবার জীবনানন্দ দাশের আঙিনার আশপাশেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। সে জন্যই ত্রিশ পরবর্তী দশকে প্রখর মেধাবী কবি ছাড়া স্বতন্ত্রভাষা নিয়ে এগিয়ে গেছেন এমন কবি সংখ্যা নেহায়েত নগন্য। পাঠক বরাবরই তৃষ্ণার্ত থাকেন নতুন কবিতা, নতুন উপমা, নতুন শব্দ চয়নে চক্ষু শীতল হয়, হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসে এমন কবিতা পাঠ করতে। অসংখ্য তারার মধ্যে মানুষ চাঁদকেই বেছে নেয়। শান্তিময় মুখোপাধ্যায় অসংখ্য তারার মধ্যে সেই চাঁদ, যাঁর আলোয় স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট আছে। তিনি নতুন শব্দ চয়নে কবিতা, লিখছেন। যা ক্ষুধার্ত পাঠক হৃদয়ের উদর পূর্তি হবে। তাঁর উপমায় দূরপ্রসারী ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। উপরের উদ্ধৃতিগুলো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নতুন শব্দচয়ন ও নতুন উপমায় তাঁর কবিতার শরীর গঠিত বলে তা সুখপাঠ্য। তাঁকে বাংলা কবিতায় আশির দশকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। তাঁর কবিতা কাল পেরিয়ে মহাকালের দরজায় কড়া নাড়ছে।