ইতিহাসের অনেক সংগঠকে আমরা অনেক সময় মনে রাখি না বা কখনো সাময়িকভাবে মনে রাখলেও বিস্মৃতির অতল গহবরে একসময় বিলীন হয়ে যায়। কখনো কখনো অস্তিত্বের প্রয়োজনে বা নতুন প্রজন্মকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করার তাগিদে স্মৃতির ভান্ডার উন্মুক্ত করে ইতিহাসের বিস্মৃত নায়কদের ইতিহাসের অন্তরাল থেকে লোক চক্ষুর সম্মুখে নিয়ে আসার জন্য সময় তাগিদ দেয়।
আহ্ছানিয়া মিশনের ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত এমনই একজন নায়ক হলেন আলহাজ এম. জওহর আলী; যিনি ছিলেন ‘আহ্ছানিয়া মিশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা বা প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৩৫ সালের ১৫ মার্চ প্রতিষ্ঠিত আহ্ছানিয়া মিশনই কালের পরিক্রমায় রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)। আলহাজ এম. জওহর আলী পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মিশনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও অধিষ্ঠ হয়েছিলেন। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর ছায়াসঙ্গী ও আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হয়েও মিশনের ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে গেছে আলহাজ এম. জওহর আলীর নাম।
প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আলহাজ এম. জওহর আলী মিশন প্রতিষ্ঠাতা হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর ছায়াসঙ্গী হিসেবে তিনি কেন্দ্রীয় মিশনের সকল দ্বায়িত্ব সফলভাবে সামলিয়েছেন। তিনি মিশনের শুরু থেকে উত্থান দেখেছেন, ক্রমবিকাশ দেখেছেন ও তার অংশ হয়েছেন। তিনি মিশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় অর্থাৎ ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মিশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর তিনি মিশনের সহ-সভাপতিসহ অন্য পদ অলংকৃত করেন। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর ব্যক্তিগত অনুভুতি প্রকাশের কেন্দ্রে ছিলেন আলহাজ এম. জওহর আলী। ১৯৪৮ সালে লিখিত এক পত্রে এর কিছু অংশ প্রকাশ পায়। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) লিখেছিলেন “পরম স্নেহাষ্পদ প্রাণাধিক জওহার, অদ্য মিঞা মোহর আলীর সহিত সাক্ষাৎ হলো, তোমার অসুস্থতার কথা শুনলেম। দীর্ঘ তিন মাস পরে বাড়ির কাছে এসে ক্রমান্বয়ে তোমার দুই খানি মহব্বতের টুকরা পেলেম।
তোমার যদি মহব্বতের তাফাজা বুঝতে, তবে এত নির্দয় থাকতে পারতেনা। খায়ের, আমিত স্মৃতিকে ছাড়তে পারিনা, সে যে আমায় সময় অসময় দগ্ধ করতে থাকে, সে কথা বুঝাবো কা কে? কোথায় পরান, কোথায় আমীন, কোথায় সুলতান, কোথায় মৌলবী করিমউল্লা,আর কোথায়বা তুমি ও চাচা হারুন? সবাই আপন কাজে ব্যস্ত, আপনার চিন্তায় মগ্ন। অপরের চিন্তার অবসর কোথায় ? আশ্চর্য এই যে সারা বিশ্ব নির্বাক। চন্ডীপুর, নাংলা, কালুতলা, মাহমুদপুর, পারুলিয়া, সখীপুর সবাই নিদ্রিত। ঘুম নাই কেবল একটী মহাপাপীর! যা’ক বেঁচে থাকতে মওতকে চাখা ভালই। ইহাতে অনেক ছবক পাওয়া যায়। সময় আসে আর যায়, আর মানুষকে মরুক’রেধায়! একেই বলে সংসার। থাক্, তোমার কোমল প্রাণে বেদনা দিবনা, সে যে ফিরে আমারই উপর পড়বে!” (১৭৫, কলিকাতা ১৯/৫/৪৮)
অত্যন্ত জনপ্রিয় মিশন সংগঠক ছিলেন আলহাজ এম. জওহর আলী। বিশেষ করে আনুগত্য, নিবিড় কর্মনিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কর্ম অভিযাত্রা এবং পরমআত্মা ও মানবকল্যাণে প্রতিষ্ঠিত মিশনের তিনি ছিলেন প্রথম সারির সংগঠক। এক নিভৃত গ্রাম নলতা থেকে সাতক্ষীরা, ঢাকা, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম সহ সকল মিশন প্রতিষ্ঠায় হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর সঙ্গী হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। কেন্দ্র ও শাখা মিশনের সাহায্যে একটি স্বতন্ত্র স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গঠিত হয় “নলতা আহ্ছানিয়া প্রতিষ্ঠান” নামে। এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন এম. জওহার আলী। মূল কথা হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর আস্থার প্রতীক ছিলেন তিনি।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকালেও মিশন আদর্শ থেকে তিনি একচুলও বিচ্যুত হননি। সাতক্ষীরা অঞ্চলের অবহেলিত মানুষের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। প্রত্যেক মানুষ তার কাছের ও আদর্শের মানুষ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নিজের জীবনেও প্রতিফলন ঘটায়। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) তার আদর্শ ছিল। পূণ্যবান মানুষ সকলকে কল্যাণের পথে আহ্বান করে; বিপদাপদে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়। তাই অনুসরণ করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে পূণ্যবান ব্যক্তির সাথে।
আলহাজ এম. জওহর আলীর বাস্তবতাবোধ যে গভীর ছিল, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এর অভিপ্রকাশ ঘটত। প্রতিটি কাজের ছোটখাটো খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে তাঁর মনোযোগ ছিল। ছোট-বড় ঘটনা, সেটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, তা সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দরভাবে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ দক্ষতা।
তিনি ছিলেন অতুলনীয় সংগঠক। কর্মীদের শক্তি-দুর্বলতা, আর্থিক সামর্থ-ঘাটতি ইত্যাদির হিসাব তাঁর নখদপর্নে থাকত। কখন কী করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, এসবের মধ্য দিয়ে আলহাজ এম. জওহর আলী হয়ে উঠতেন সেই কাজের নেপথ্য নায়ক। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র.)-এর বিভিন্ন লেখনি ও পত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি তাঁর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে।
“পরম প্রিয় জওহার, অদ্য চট্টগ্রাম যাইবার জন্য প্রস্তুত হতে আছি। সেখানে কয়েক দিন থেকে খুলনায় আসবো এবং যথাসময়ে তোমাদের নিকট পৌঁছিব। অদ্য মুদ্রিত প্রোগ্রাম পাঠালাম পবিত্র ফাতেহা দোয়াজদহম উপলক্ষে। প্রাপ্তি মাত্রই বিলি করবে ও প্রত্যেক শুক্রবার শাখা মিশনের কর্তৃপক্ষদিগকে ডাকাইয়া কর্ত্তব্য স্থির করবে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার সদস্য ও পৃষ্ঠপোষকদিগকে এখান হতে কার্য্যসূচী বন্টন করলাম। তুমি শাখা মিশনগুলি কে distribute করবে।
খোদার ফজলে ভালই আছি। বাড়িতে দোওয়া বলবে ও ছোটদিগকে আশীস্ দিবে। সুলতান মিঞা ও আহমদ খাঁ ছাহেবকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কাজগুলি সুসম্পন্ন করে ফেলবে। সখীপুরের করিম মিঞা ও পারুলিয়ার বাহাতউল্লা মিঞাকে ও সঙ্গে নিবে।” (পত্র : ২৭৬। ঢাকা, ৮/১২/৫০)।
মিশনকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আলহাজ এম. জওহর আলী ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কাকে কখন কোন কথা বলতে হবে, কাকে দিয়ে কখন কোন কাজ করাতে হবে, কার মাধ্যমে কোন কথা কার কাছে পৌঁছাতে হবে অথবা হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর নির্দেশ মত কখন বৈঠক ডাকতে হবে।
বিভিন্ন বিষয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে তিনি অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। সামর্থ বিন্যাস কিভাবে কঠিন কাজকে কতটা অনুকূলে নিয়ে আসা যায়, সে সম্পর্কে তাঁর হিসাব-নিকাশ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি সেটা খুব ভালোভাবে হিসাব করে পদক্ষেপ নিতে পারতেন।
মিশন প্রতিষ্ঠাতা হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) স্বপ্ন দেখতেন মানব কল্যাণের। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আলহাজ এম. জওহর আলীকে সময় যেন তাড়া করে বেড়াতো। মিশন প্রতিষ্ঠাতার ইন্তেকালের পর তিনি জীবিত থাকতেই আহ্ছানিয়া মিশনকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রাণান্তকর প্রয়াসে তিনি তাঁর সর্বসত্তা নিবেদন করেছিলেন। মিশনের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তিনি তাঁর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ত্বরিত গতিতে প্রবাহিত করার নানা প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। ব্যাকরণগত ভাবে শুদ্ধ নয় এমন কিছু কৌশলী পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। হয়ত তাঁর উদ্যোগ ও অবদান ইতিহাসে সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে, লোক চক্ষু থেকে দূরে থেকে গেছে।
আলহাজ এম. জওহর আলী ছিলেন সর্বাংশে একজন খাঁটি মুসলমান, সাম্যবাদী সমাজকর্মী ও সূফি আদর্শের প্রতি আত্ম-নিবেদিত। মিশনের জন্য তিনি সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। মিশন ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার প্রধান কেন্দ্র। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ও মিশন ছিল এক নাড়িতে বাঁধা অভিন্ন সত্তা। এই ভিত্তির ওপর নির্ভর করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন অদ্বিতীয় সংগঠক। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার কারনে মিশন প্রতিষ্ঠাতা তাকে মিশনের ‘প্রধান স্তম্ভ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মিশনের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক মিশন প্রতিষ্ঠাতা তাঁকে লিখেছিলেন- “কেন্দ্রীয় মিশনের প্রধান স্তম্ভ প্রাণাধিক বাবা জওহার আলি, এবার দুটী মাস মফস্বলে ছিলাম, কি সাদর আহ্বান পেয়েছি তাহা পত্রে প্রকাশ করতে অক্ষম। বহু লোক মিশনে যোগদান করেছেন এবং বহু লোক গরীবের ছেলছেলা ভুক্ত হয়েছেন। জনৈক মাওলানা স্বপ্নে জেনেছেন মিশনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে, উজ্জ্বলতর হবে আমার বিহনে। গণাকরকাটির বহু লোক সম্মিলিত হয়েছিলেন এবং গ্রামের প্রায় অর্ধাংশ ব্যক্তি যোগদান করেছিলেন মিলাদ শরীফে এবং মিশনের জন্য যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছেন। আমার নিজের স্বার্থ কিছুই নাই। সকল স্বার্থ খোদারই জন্য ও তাঁর বান্দার জন্য। তাই আমার বিশ্বাস এই পবিত্র মিশন অচিরে স্বীয় পদে দন্ডয়মান হবে।” (পত্র : ১১৫৫। কালীগঞ্জ ২৭/১/৬১)
নওজোয়ান এম. জওহর আলী মিশন প্রতিষ্ঠাতার ছায়ায় দিনে দিনে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। হযরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)-এর মান-অভিমান, মনোকষ্ট বুঝে প্রকৃত সম্মান দিয়েছেন। তিনি ছাড়াও তাঁর পুরো পরিবারকে তৈরি করেছেন মিশন প্রতিষ্ঠাতার আদর্শে। বাবা আলহাজ এম. জওহর আলীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সন্তানরাও নিবেদিত হয়েছেন মিশনের কাজে-কর্মে ও মিশনের অগ্রগতিতে। তাঁর মেয়ে মাহমুদা খাতুন ছিলেন মিশন প্রতিষ্ঠাতার অত্যন্ত স্নেহধন্য ও মহিলা সমিতির সংগঠক। পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর ছেলে ড. গোলাম মঈনউদ্দিন, গোলাম শরফুদ্দিনসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণও মিশনের বিভিন্ন কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে মিশনকে সমৃদ্ধ করেছেন। কর্মবীর আলহাজ এম. জওহর আলী ১৯৯১ সালে আনুমানিক ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
লেখক: ইকবাল মাসুদ, পরিচালক, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য, নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন।