মহাসড়ক বিক্রি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই,, অথচ জেনে অবাক হবেন যে, এই মহারথী বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাজমহল..
তাও একবার নয়, তিন তিন বার তাজমহল বেচে দিয়েছিলেন। এছাড়াও একের পর এক ঐতিহাসিক মিনার বিক্রি করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। তাজমহল, রেড ফোর্ট, রাষ্ট্রপতি ভবন.. এমনকি ৫৪৫ জন সংসদ সদস্য সহ বেচে দিয়েছিলেন ভারতের পার্লামেন্ট ভবনও।
ভারতের ইতিহাসে বিখ্যাত সেই প্রতারকের নাম নটবরলাল। অমিতাভ বচ্চনের ছবি ‘মিস্টার নটবরলাল’ এর প্রেরণা তিনিই।
বিহারের সিবান জেলার বাংরা গ্রামে জন্ম এই নটবরলালের। পেশার শুরুতে আইনজীবী ছিলেন তিনি। নাম মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব।
প্রথমে আইনজীবি হিসাবে পেশা শুরু করলেও পরে বুঝতে পারেন প্রতারণা পেশায় তার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তাই প্রতারণাই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। নানারকম ফাঁদে ফেলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়াটাই হয়ে ওঠে তার নেশা। বাদ যাননি টাটা বিড়লা, অম্বানি, মিত্তলও। বড় বড় সব শিল্পপতিদেরও অনায়াসে ঠকিয়েছেন তিনি। ইংরেজিতে অসামান্য পারদর্শী এই ব্যক্তি অন্য কারো স্বাক্ষর নকল করতে পারতেন নিখুঁতভাবে।
৬৬ বছর ধরে ভারতের ৮ টি রাজ্যে প্রায় ৫০টি ছদ্মনাম ব্যবহার করে প্রায় ৪০০ লোককে ঠকিয়ে আয় করেছেন কোট কোটি টাকা। প্রতারনার কাহিনী গুলো ছিলো চমকপ্রদ। সবসময় পোষাকে ছিলেন ফিটফাট, কাছে থাকতো সরকারী দফতরের সীল কাগজপত্র।
একবার এক ঘড়ির দোকানে গিয়ে নিজেকে কেন্দীয় অর্থমন্ত্রী নারায়ণ দত্ত তিওয়ারীর সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে দোকান মালিককে বলেন সফররত বিদেশী অতিথিদের ৯০ টি দামি ঘড়ি উপহার দেয়া হবে। সরকারী ছাপমারা প্যাডে মন্ত্রীর সই করা চিঠি দেখিয়ে ৯০ টি দামী ঘড়ি ডেলিভারি নিয়ে সরকারী ড্রাফট দেয় সে। পরে ড্রাফট ভাঙ্গাতে গিয়ে দোকান মালিক বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন কিন্তু ততক্ষনে পাখি হাওয়া..
নটবরলাল লখনৌ জেলে থাকা অবস্থায় তার বউ চিঠি পাঠায় কিন্তু সে কোন উত্তর দেয় না। এভাবে পরপর ৮টা চিঠির কোন উত্তর না দেয়ায় নবম চিঠি হাতে করে এসে জেলার তাকে বলে এবার চিঠির উত্তর দিতেই হবে। তার বউ চিঠি লিখেছে ঘরে টাকা পয়সা নেই জমি চাষ করবো কিভাবে? জমি চাষ না হলে এবার ফসল বোনা হবে না। সে উত্তর দিলো জমির এক জায়গায় মাটির এক ফুট নিচে কিছু সোনা লুকানো আছে, সেখান থেকে কিছু সোনা নিয়ে আপাততঃ কাজ চালাও। জেল থেকে বেরিয়ে বাকি ব্যবস্থা করবো। নটবরের সে চিঠি পৌছানোর আগেই পুলিশ পৌছালো গ্রামে.. সমস্ত জমি তন্ন তন্ন করে জমিতে সোনা খুঁজে শুণ্য হাতে ফিরে গেলো… কিন্তু কিছুদিন পর জেলখানায় তার বউয়ের চিঠি এলো যে, আপততঃ টাকার দরকার নেই, পুলিশের খোঁড়াখুঁড়ি করা জমিতে ফসল বুনে এবার খুব ভালো ফসল হয়েছে…
কোর্টে একবার এক বিচারক তাকে প্রশ্ন করলেন মানুষকে ঠকাও কি কিভাবে? সে বললো এটা জানার জন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে। বিচারকের কাছে এক টাকা নেবার পর বললেন আমি লোকেদের কাছে টাকা চাই, তারা এভাবেই আমাকে টাকা দেয়। আমি কাউকে বন্দুক ঠেকিয়ে বা মারধর করে লুঠ করিনা। কোন মামলাই আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ বা আঘাতের অভিযোগ নেই। আমি চেয়েছি ওরা দিয়েছে। সরকার চাইলে আমার কাছে বুদ্ধি ধার নিতে পারে….
১০০-রও বেশি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন নটবরলাল। দেশের আটটি রাজ্যে পুলিশের খাতায় নাম ছিল তাঁর। সব মিলিয়ে ১১৩ বছরের জেল হয়েছিল। কিন্তু, তিনি সর্বসাকুল্যে মোট ২০ বছর জেল খাটেন। যতবারই তাঁকে গ্রেফতার করা হত, ততবারই পালিয়ে যেতেন তিনি। একবার তো পুলিশের পোশাক চুরি করে পরে সদর্পে হেঁটে জেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেষবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তাঁর বয়স ৮৪ বছর। অসুস্থ থাকায় তাঁকে যখন জেল থেকে বের করে নিয়ে আসা হচ্ছিল সেইসময় স্টেশন থেকে উধাও হয়ে যান তিনি। আর তাঁকে দেখা যায়নি। তাঁর মৃত্যুও রয়ে গিয়েছে রহস্যেই। আইনজীবীর মতে তাঁর মৃত্যু হয় ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই আবার তাঁর ভাই বলেন ১৯৯৬ তে রাঁচিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। প্রতারনার ইতিহাসে পৃথিবীর সেরা দশ জনের মধ্যে তিনি একজন তাই মৃত্যু নিয়েও রেখে গেছেন রহস্যের ছাপ….
✍লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান।