সরকারবিরোধী বৃহত্তর ‘জাতীয় ঐক্য’ গড়তে ৫ দফা দাবি ও ৯ লক্ষ্যে ঐকমত্য হয়েছে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি ছাড় দিয়েছে কয়েকটি ইস্যুতে। এ বাস্তবতায় আজ শনিবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্য ঘোষণা করা হবে। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত অধিকাংশ দল আজ একমঞ্চে আসছে।
জাতীয় ঐক্যের অন্যতম উদ্যোক্তা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্ট ও বিএনপির সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য হবে। আজকের কর্মসূচিতে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি থাকছে না। ধীরে ধীরে সবাই এ ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির পক্ষে এক বুদ্ধিজীবী ও দলের এক ভাইস চেয়ারম্যান বৈঠক করেছেন ড. কামাল হোসেন ও মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে। কথা বলেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী ও সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গেও। এসব বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, আলোচনার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা, বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া, আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ইভিএম পদ্ধতি বাতিলÑ এ ৫ দফার দাবিতে ঐকমত্য হয়েছে।
নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য হবেই। বিএনপি ছাড় দিয়ে হলেও এ ঐক্য করবে। কেউ যদি এ ঐক্যে সম্পৃক্ত না হয়, তা হলে বিএনপি একাই নামবে এবং তাতে বিএনপি সফল হবেই।
এদিকে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর তোপখানা রোডে নাগরিক ঐক্যের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকেও এ ৫ দফা দাবি চূড়ান্ত করা হয়। একই সঙ্গে সরকারে গেলে রাষ্ট্রের কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার আনা হবে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী করবেনÑ এ সংক্রান্ত ৯ দফাসংবলিত একটি লক্ষ্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন জানান, আজ শনিবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ
মিনারে বৈঠকের নেওয়া সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ক শহীদুল্লাহ কায়সার বলেন, যুক্তফ্রন্টের ৯ দফা ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় ৭ দফা সমন্বয় করা হয়েছে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, প্রথমে ঐক্য প্রক্রিয়ায় জামায়াত মূল বাধা হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু বিএনপি ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের বুঝিয়েছেন, জামায়াত তো কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলই নয়। সে ক্ষেত্রে তাদের ছেড়ে দিলে সরকার বাড়তি সুবিধা নেবে। আন্দোলনের স্বার্থে এ দিকটি সবার মাথায় রাখতে হবে। ফলে বিএনপি মনে করে, এই ঐক্য শেষ পর্যন্ত হবে।
জানা গেছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে গণফোরাম, যুক্তফ্রন্টসহ বাম প্রগতিশীল ধারার বেশ কিছু দল সম্পৃক্ত হবে। এ লক্ষ্যে বিএনপির পাশাপাশি নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির একটি প্রচেষ্টা আছে।
জামায়াত প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা ঐক্য করছি বিএনপির সঙ্গে, ২০ দলের সঙ্গে নয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ঐক্য প্রক্রিয়া এখন সময়ের দাবি। আমরা গত ১০ বছর ধরে যে কথাগুলো বলেছি, তারাও এখন আমাদের কথাগুলো বলছে। আমাদের দাবিগুলো জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তারাও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চায়। গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থেই এসব দরকার। বিএনপি আশা করে, এই ঐক্য শেষ পর্যন্ত হবে।
জানা গেছে, এর মধ্যে কয়েকজন নেতা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে যুগপৎ আন্দোলনে নামতে একমত হয়েছেন। যুক্তফ্রন্টসহ ওই কেন্দ্রিক দুই-তিনজন নেতার কথায় বিএনপির ওই নেতা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারেননি। তিনি বিষয়টি দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে অবহিত করেছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একজন নেতা খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিবেশী একটি দেশের অসন্তুষ্টি রয়েছে বলে জানান। আরেকজন নেতা আন্দোলনের পর সরকারে গেলে এর পরিচালনা-কাঠামো কেমন হবে, সে বিষয়ে আগাম সমঝোতার অভিপ্রায় তুলে ধরেন। এ অবস্থায় বিএনপি সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাচ্ছে। ঐক্য গড়তে বিএনপির তরফ থেকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনা, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি কী করবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করতেও প্রস্তুত। ঐক্য হলে গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টকে আলোচনাসাপেক্ষে নির্দিষ্টসংখ্যক আসন ছেড়ে দেওয়ারও চিন্তা আছে বিএনপির।
জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্যগুলো হলো
১. আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণার আগেই বর্তমান সংসদ ভেঙে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে এবং নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
২. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার লক্ষ্যে বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যম ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
৩. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আনীত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি দিতে হবে। এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।
৪. নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত প্রতিটি এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
৫. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বন্ধ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর যুগোপযোগী সংশোধনের মাধ্যমে গণমুখী এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
লক্ষ্য : ১. প্রশাসন ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণসহ প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাঠামোর অবসান করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন, ন্যায়পাল নিয়োগ, বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যুগোপযোগী সংশোধন করা। জনগণের ক্ষমতায়ন ও সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগদানের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।
২. দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতিকে কঠোরহস্তে দমন এবং এর আগে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
৩. দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা বিকাশসহ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।
৪. কৃষক, শ্রমিক ও হতদরিদ্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।
৫. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা।
৬. রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক সচ্ছলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা নিশ্চিত, জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
৭. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করা।
৮. সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরীতে নয়Ñ এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯. বিশ্বের সব নিপীড়িত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণসমর্থন; মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।
সূত্র: আমাদের সময়