কাছ থেকে দেখা – মৃত্যুপুরি ২১ আগস্ট
——–অধ্যক্ষ শাহজাহান সাজু———
আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলংময় মাস হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে আছে । ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পাক-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এদেশীয় এজেন্টরা অত্যন্ত নির্মমভাবে স্ব-পরিবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে একাত্তরে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে অবস্হান করায় সেদিন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিেন। ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের সেই আগস্ট মাসেরই ২১ তারিখ প্রকাশ্য দিবালোকে বিএনপি – জামাত জোট সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্হ আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল।
২১ আগস্ট গ্রনেড হামলার আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। আজো সেই নির্মম, নিষ্ঠুর, ভয়ারহ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে গা শিউরে উঠে । আমার চোখের সামনে সেদিন নারী নেত্রী আইভি রহমান, আমার বন্ধু ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাক আহমেদ সেন্টু সহ শত শত নেতা কর্মীর ক্ষত বিক্ষত দেহ , আহতদের গগণ বিদারী চিৎকারে সেদিন বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ ও আশেপাশের এলাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল । সেই হামলায় সেদিন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী আইভী রহমান সহ ২৪ নেতকর্মী নিহত হন । আহত হয় আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতা কর্মী । পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলা বিশেষ রহমতের ছায়া দিয়ে সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
২১ আগস্ট নেত্রী যে ট্রাকটিতে দাড়িয়ে বক্তব্য রাখছিলেন সেই ট্রাকটির পাশেই আমি আর সেন্টু (সেদিন নিহত) একসাথে দাড়ানো ছিলাম । উল্লেখ্য অনেক দিন পর সেদিনের সমাবশস্হলেই সেন্টুর সাথে আমার দেখা । সেন্টুই আমাকে জোর করে মঞ্চের কাছে নিয়ে যায় । আমার হাতে আমার কলেজের মামলা সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ছিল বলে আমি সেদিন মঞ্চের কাছে ভিড়ের মধ্যে যেতে চাইনি ।
নেত্রীর বক্তব্যের শেষ মূহুর্তে আমি সমাবেশের জন্য ট্রাকের উপর স্হাপিত অস্হায়ী মঞ্চ থেকে একটু দুরে সরে আসি । নেত্রীর বক্তব্যের পরই সন্ত্রাস বিরোধী শান্তি মিছিল শুরু হলে মিছিলে ধাক্কা ধাক্কি হবে এবং আমার হাতে থাকা আমার কলেজের মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপুর্ণ ফাইলটি হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে নেত্রীর বক্তব্যের শেষ মুহুর্তে আমি মঞ্চ থেকে একটু দুরে সরে আসি ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিএনপি জামাত জোট সরকার ২০০৪ সালে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে আমাকে অন্যায়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে আমার নিজের প্রতিষ্ঠিত কলেজ থেকে আমাকে চাকুরীচ্যুত করে । আমি এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছিলাম । ঐ মামলার কাগজপত্র নিয়ে সমাবেশের পর ঐদিন সান্ধায় এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু (সাবেক আইন মন্ত্রী,সম্প্রতি প্রয়াত) এবং ব্যারিস্ট্রার শিরিন শারমিন (বর্তমান স্পিকার) এর তোপখানা রোডস্থ চেম্বারে যাবার কথা ছিল। সভা শেষে মিছিলে ধাক্কা ধাক্কির ভয়ে আমি শেষ মূহুর্তে মঞ্চের কাছ থেকে একটু দুরে সরে আসতে না আসতেই বিকট শব্দে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে থাকে। উপস্থিত হাজার হাজার দলীয় নেতা কর্মী চারিদিকে ছুটতে থাকে। এক পর্যায়ে আমিও জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাই । কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে আইভি রহমান সহ কিছুক্ষণ পুর্বে আমার পাশে থাকা আমার বন্ধু ছাত্রলীগ নেতা সেন্টু সহ অসংখ্য মানুষের ছিন্নভিন্ন ক্ষতবিক্ষত দেহ এবং চারিদিকে শুধু রক্ত আর মানুষের নিতর দেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি । অসংখ্য মানুষের আত্বচিৎকারে তখন এমন এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । আমার তখন ধারণা হয়েছিল নেত্রী বেচেঁ নেই । আমি এখনো বিশ্বাস করি ২১ আগস্ট মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রহমতের ছায়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণে রক্ষা করেছিলেন ।
২১ আগস্টে যদি খুনিদের মিশন সফল হতো তা হলে আজ বাংলাদেশের কি অবস্থায় হতো ? এট নিঃসন্দেহে বলা যায় ২১ আগস্ট খুনিদের মিশন সফল হলে বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চারণভূমিতে পরিণত হতো। এতদিনে হয়ত বাংলাদেশ আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানের মত জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হতো । প্রায় দেড় যুগ অতিক্রান্ত হতে চলেছে এখনো সেই নারকীয় গ্রেনেড হামলার বিচার কার্য সমাপ্ত হয়নি । ঘাতকদের ফাঁসির রায় এখনো কার্যকর হয়নি। এই বিচারের জন্য আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে ? অবিলম্বে বিচার কার্যের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে ।