আমাদের বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় সত্তর দশকের কবিদের পথচলাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা খেয়াল করি। তা হলো এদশকের কবিবৃন্দ প্রায় সকলেই প্রচলিত ছন্দের রীতিনীতিতে দারুণ সিদ্ধ। অবাক সচল। তাঁরা কবিতায় যথোপযুক্ত ছন্দের প্রয়োগ করে কবিতাকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কবি মাহমুদ কামাল ভাইও এই ছন্দের আঙিনায় একজন দক্ষ নৌচালকের মতো কাপ্তান। সুলতান সুলেমানের জামানায় বলা হতো কাপ্তান ই দরিয়া।
কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর সব কবিতাই ছন্দের ঠাসবুনটে সুগঠিত। অর্থাৎ তাঁর কবিতার যে সড়ক তিনি নির্মাণ করে চলেছেন তা মসৃণ ও ছন্দের যথোপযুক্ত ব্যবহারে দারুণ। তাঁর কবিতার রস আস্বাদনে আমরা তৃপ্ত হই। আবেশে মাঝে মাঝেই আমাদের চোখ বুঝে আসে।
কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর নামের সঙ্গে আমার পরিচয় উনিশ বছর আগেই। লিটল ম্যাগাজিন উদ্যান সম্পাদনা করতে যেয়ে বাংলাদেশ ও কোলকাতার সমসাময়িক ও অগ্রজ অনেকের নামই জানি।সাক্ষাৎ সবার সঙ্গে হয়নি। মাহমুদ কামাল ভাই এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়নি।২০০৩ সালে উদ্যান লিটলম্যাগের একটি সংখ্যা বের করার পর তা টাঙ্গাইলে কুরিয়ার করি।আর বাস্তবে কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর সঙ্গে মোলাকাত হলো ২০২০ এর টাঙ্গাইল কবিতা উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে যোগদানের পর। প্রথম দর্শনেই যখন কবি কুশল ভৌমিক পরিচয় করিয়ে দিলেন মাহমুদ কামাল ভাই এর সঙ্গে তখন প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও স্মিত হেসে বললেন কেমন আছেন?? অবাক হয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে ছিলাম তাঁর মুখের দিকে। কারণ তখন সারা বাংলাদেশ থেকে এবং ভারত থেকে প্রায় সাড়ে চারশত কবি সমবেত যে অনুষ্ঠানে সেই অনুষ্ঠানের প্রাণভোমরা হাসিমুখে কাজ করে যাচ্ছেন। সবাই ঠিকঠাক দুপুরের লাঞ্চ করছেন কিনা সেটার খোঁজ রাখছিলেন আবার অনুষ্ঠানের প্যান্ডেলের দিকেও ছুটে যাচ্ছেন বারবার। তাঁর সঙ্গে টাঙ্গাইলের একঝাঁক তরুণ কবি কাজ করছেন। আমি কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর সাংগঠনিক দক্ষতার সমুদ্রসম বিশালতা অনুভব করছিলাম। টাঙ্গাইলের কবিতা উৎসবের তিনদিন কথা খুব একটা না হলেও এরপর নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। একটা সময় তাঁর স্নেহের চাদরে জড়িয়ে তাঁর আশেকে পরিণত হলাম। সাধারণত অগ্রজদের ( বর্তমান সময়ে) অনেকেই অনুজদের ব্যবহারের একটা চতুর কৌশল লক্ষ্য করি, কিন্তু মাহমুদ কামাল ভাইকে দেখলাম ব্যতিক্রম। তিনি অনুজদের ভালোবাসেন হৃদয়ের গহীন জায়গা থেকে। যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই। উদ্যান লিটলম্যাগের প্রবন্ধ সংখ্যা বের করার পর ডিসেম্বরে ঢাকায় একটা প্রকাশনা উৎসব করেছিলাম বেইলি রোডে। আগের দিন মাহমুদ কামাল ভাই কে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সানন্দ চিত্তে রাজি হোন এবং দুপুরেই হাজির হয়ে যান বেইলি রোডে। কবি কুশল ভৌমিক ও কবি রুদ্র মোস্তফা সেদিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আমরা একসঙ্গে দুপুরের ভোজে অংশ নিয়েছিলাম। সে এক দারুণ স্মৃতি। তাঁকে যখন বলেছিলাম কি খাবেন?? জবাবে বলেছিলেন, আপনারা যা খাবেন আমিও তাই খাবো। এমন নিরহংকার অগ্রজ নিকট অতীতে পাইনি।আমরা নবাবী ভোজে দুপুরের খাবার খেয়ে বেইলি রোডের শর্মা হাউজের চারতলায় চলে যাই যেখানে অনুষ্ঠান। খুব সকালে টাঙ্গাইল থেকে রওনা দিয়ে ঢাকায় এসে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আবার সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলের পথে রওনা হওয়া, সাহিত্যের জন্য কবিতার জন্য অনুজের প্রতি এমন নিখাঁদ ভালোবাসা যিনি দেখাতে পারেন তিনি একজন প্রকৃত মানুষ ও কবি। তাঁকে স্যালুট জানাই। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার কাছে নতজানু হই বারবার।
টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন ১৮ মে ২০২১। আমি ও কবি স্নিগ্ধা বাউল সকাল সাতটায় ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে টাঙ্গাইল গেলাম। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে কবি কুশল ভৌমিকের নেতৃত্বে আমরা মহেরা যাদুঘর ঘুরেফিরে দুপুরে স্মরণ কালের সবচেয়ে বড়ো মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণ করি কুশলের বাসায়। বিকেলে যাই টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের অনুষ্ঠানে। সেখানে কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর যে স্নেহের বৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষণ করেন তার রেশ আজ অব্দি রয়ে গেছে,তখন বাইরে চলছিলো প্রকৃতির খেয়ালে অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর ভেতরে কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর স্নেহের ঝড়- বৃষ্টি। আমি সিক্ত হচ্ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন নৈশভোজে। এবার রীতিমতো আতঙ্কে কাঁপতে থাকি, দশ আইটেমের ভর্তা, ইলিশ, চিকেন, মাটন, ডাল, মলা মাছ, আরো হরেক রকমের খাবার যখন ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে আমাদের ড্রইং রুম থেকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন আমরা এই মহান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় নতজানু। হৃদয়ে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছেন প্রতিদিনই তাঁর প্রতি কৌতূহল জাগে। তাঁকে ফোন করি। খোঁজ নেই।
শিশুর মতো মানুষ, কবি মাহমুদ কামাল। হৃদয় যাঁর আসমানের মতো বিশাল, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো যাঁর স্নেহ আছড়ে পড়ে তরুণদের হৃদয় তীরে। তাঁকে ঘিরে একটা মৌচাক তৈরি হয়েছে। সাহিত্যের মৌচাক। তিনি সেই মৌচাকের রাজা। কিন্তু নিরহংকার এক সাহিত্যের সেবক এই রাজা। যাঁর কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। নম্রতা, ভদ্রতা, আচার,আচরণ, ব্যবহার শেখার জন্য আমাদের বারেবারে ফিরে ফিরে কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর দরোজায় কড়া নাড়তেই হবে।
জীবন তো মৃত্যুরই ডাকনাম
বিন্দু থেকে হেঁটে এসে
বিন্দুতেই ফিরে আসে ঢেউ
এই ঢেউ জীবনকে জাগিয়ে দেয় নির্দিষ্ট সীমানায়
এর বাইরে তুমি আমি কেউ নই
ছকের জীবন কিংবা ছকহীন উদোম ক্যানভাসে
আঁকা ছবি একই অর্থে প্রকাশিত।
হ্যাঁ কিংবা না-এর দ্বন্দ্বে
যত হইচই
সবই এক সূত্রে গাঁথা
জীবনের ডাকনাম মৃত্যু বলেই
মৃত্যুরও নাম আছে জীবনের কাছে।
তাঁর কবিতা গভীর অর্থবহ। জীবন কে চিনতে শেখায়। অস্তিত্ব কে জানতে সাহায্য করে।
কবি মাহমুদ কামাল ভাই পয়তাল্লিশ বছর ধরে ” অরণি” লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করছেন। এ পর্যন্ত তাঁর ৪৫ টি গ্রন্থ প্রকাশিত। এরমধ্যে ১৯ টি কবিতার বই।
আজ কবি মাহমুদ কামাল ভাই এর প্রিয়দিন জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা শুভকামনা শ্রদ্ধা। আপনি শতায়ু হোন মাহমুদ কামাল ভাই।