আমাদের দেশের দলীয় রাজনীতিতে সভা-সমাবেশে বড় বড় কথা বলা আর কাজে কোলাবরেটর-এর ভূমিকা পালন করা নেতৃবৃন্দের সংখ্যা একেবারে নেহাত কম নয়। আসলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আজ ন্যায়-নীতি- মূল্যবোধ এবং জনস্বার্থের প্রতি বিশ্বস্ত লোকের সংখ্যাই বিরল। এরই মধ্যে রক্তক্ষয়ী এক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পাঁচদশক পেরিয়ে গেলেও, এই সময়ের মধ্যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। নির্বাচিত-অনির্বাচিত অনেকে ক্ষমতায় এসেছেন, আবার অনেকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে যারাই পদচারণা করেছেন তাদেরকেও জনগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখার সুযোগ পেয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করার সময় অনেক দলনেতাকেই বড় বড় কথা বলতে দেখা গিয়েছে। অনেকেই আবার ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে বিপ্লবী বুলি আর রক্ত গরম করা স্লোগান দিয়ে দলীয় কর্মীদের উত্তেজিত করেছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কথা আর কাজে কোনো সঙ্গতি রক্ষা করা অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। দল পরিচালনায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দরা জনগণের রায় প্রার্থনা করেন এবং নির্বাচনী ইশতেহারে বক্তৃতা-বিবৃতিতে দুনিয়ার সবকিছু দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। অথচ নির্বাচন পেরুলে তারা সবাই সংকীর্ণ স্ব-স্বার্থ ছাড়া অন্যান্য সব কিছুই বেমালুম ভুলে যান। বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নেতৃত্বের অভাবে গত একান্ন বছরে কিছু মানুষ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন আর ব্যাপক জনগোষ্ঠী নিঃস্ব হয়েছেন। কিছু মানুষের জৌলুস বেড়েছে আর ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা-দুর্দশা সম্প্রসারিত হয়েছে।
অপ্রিয় হলেও সত্য- এই পাঁচদশকের মধ্যেই স্বাধীন দেশের মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর চেহারা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একাধিকবার দেখেছেন। দেখেছেন বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও রাজপথে গরম গরম বক্তৃতা আর রাতের আঁধারে দল-ব্যক্তির স্বার্থে দেন-দরবার চালাবার উৎকৃষ্ট প্রয়াস। তাঁরা আরও দেখেছেন ব্যক্তির যাদুমন্ত্রে কতোই না দলীয় নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করতে। একই সাথে তাঁরা দেখেছেন কতো রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গা-গড়াসহ উত্থান-পতন। এমনকি– তাঁরা আরও দেখেছেন দেশের ছোট-খাটো রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বড় বড় দলের নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত মুখে বলেন এক আর কাজে করেছেন ভিন্ন। ইতিমধ্যেই এই সুযোগসন্ধানী-অতিউৎসাহী নেতৃবৃন্দের স্বার্থের মাশুল যোগাতেই অভাগা স্বাধীন দেশের জনসধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এই কোলাবরেটর-এর ভূমিকা পালনের জন্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্পর্কে জনমনে যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই শুন্যতার সুযোগে অনেকের পক্ষেই বিজয়ের একান্ন বছর পরেও স্বাধীন দেশের জনমানুষকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে অধিকারহীন করে রাখা সম্ভব হয়েছে। তাই বলতে দ্বিধা নেই, এই দেশটা কী শুধু সরকার আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের? এমনকি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে, এই সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক সংকটকালীন সময়ে জনসাধারণের পাশে থাকেন না। এরা যা কিছুই করেন না কেন, স্ব-স্বার্থ আর লোক দেখানো আত্মপ্রচার-প্রচারণার জন্যই তা করে থাকেন।
আমাদের সমকালীন রাজনীতির যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এই বৈশিষ্ট্য যতোদিন বহাল থাকবে ততোদিন আর যা-ই হোক; জনসাধারণ সুযোগসন্ধানী-অতিউৎসাহী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করতে পারে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা যদি মনে-প্রাণে চান যে দেশের মানুষের অধিকার থাকা দরকার, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশীদারিত্ব থাকা দরকার: তাহলে তাদের প্রত্যেককেই প্রকাশ্যে এককথা আর গোপনে ভিন্ন কাজ করার মানসিকতা সর্বত্রভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের সবারই মনে রাখা উচিত, দেশটা তো শুধু সরকার আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের নয়। এর বাইরেও বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। যাদেরকে পাশ কাটিয়ে দেশের মঙ্গল সাধন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই মূহুর্তে বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দরকার মানুষের পাঁচ ধরনের স্বাধীনতা, যার অন্তর্ভূক্ত অর্থনৈতিক সুযোগ, সামাজিক সুবিধাদি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, স্বচ্ছতার গ্যারান্টি ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা।
তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে- এ সমস্যা সমাধানের জন্য দল-মত এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনকল্যাণকামী রাজনৈতিক আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব আর জনগণের স্বার্থপূর্ত অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করে একটি আত্মদায়বদ্ধ সামাজিক সংগঠন প্রজন্মের চেতনা।
লেখক :ছাব্বিবুর রহমান
এমএসএস”সমাজকর্ম “ ঢা বি