চবি প্রতিনিধি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য হিসেবে চার বছরের অধিক সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। গত ০৩ নভেম্বর দায়িত্ব পালন তাঁর চার বছর পূর্ণ হয়। তবে নতুন উপাচার্য নিয়োগ না হওয়ায় তিনি এখনও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তবে গুঞ্জন আছে, খুব শিগগিরই নতুন উপাচার্য পেতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম শীর্ষ এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের জন্য নিয়োগ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিক শিক্ষকের নামের তালিকা জমা পড়েছে। তাদের মধ্যে পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতির দায়ে শাস্তি প্রাপ্ত শিক্ষকের নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি অনুষদের চারজন সাবেক ও বর্তমান ডিনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতির দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদও। তিন জনের প্যানেলে তাঁর নাম না থাকলেও একজন মন্ত্রীর মাধ্যমে তিনি উপাচার্য হওয়ার জন্য বেশ তৎপর বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, কোন শিক্ষকের আত্মীয় পরীক্ষার্থী হলে পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের নিমিত্তে উক্ত শিক্ষক পরীক্ষা কমিটির সদস্য, প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও উত্তরপত্র পরীক্ষক হতে পারবেন না। অর্থাৎ অধ্যয়নরত আত্মীয়-শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট কোন পরীক্ষার
কার্যাবলী থেকে উক্ত শিক্ষক সম্পূর্ণ বিরত থাকবেন। কিন্তু নিজের আপন বোন পরীক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও বিভাগের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে অধ্যাপক ফরিদ এম.এস.এস. পরীক্ষা, ২০০৫-এর পরীক্ষা কমিটির সভাপতির সাথে বসে টার্মিনাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মডারেশন করেন। এসময় তিনি ৩ জন কোর্স শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশ্ন গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের ৪৫০ তম জরুরি সভায় তাকে বিভাগের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ হতে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে শাস্তি প্রদানের সাথে সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল ও পিএইচ.ডি কোর্সে গবেষণার নীতিমালা অনুযায়ী ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ আজীবনের জন্য কোন এম.ফিল বা পিএইচ.ডি কোর্সের ছাত্রকে সুপারভাইজ করার যোগ্যতা হারান।
তাঁর সম্পর্কে সিন্ডিকেট সভার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ বিভাগীয় সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। টিম লিডার হিসাবে তিনি বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে পারেননি। বিভাগের গোপনীয় দলিলপত্র সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিভাগের জরুরী ও গোপনীয় দলিলপত্র সভাপতির লকারে সংরক্ষণ না করে অফিস সহকারী লোকমানের নিকট সংরক্ষণ করেছেন। এছাড়া আপন বোন উক্ত বিভাগের এম.এস.এস. ২০০৫ সালের পরীক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরীক্ষা কমিটির সভাপতির সাথে একত্রে বসে প্রশ্নপত্র মডারেশন ও তৈরী কাজে সহায়তা করে অনৈতিক ও আইন বিরোধী কাজ করেছেন, সহকর্মীদের আস্থা হারিয়েছেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট সভাপতি হিসাবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও হারিয়েছেন। তিনি বিশ্বব্যিালয়ের উল্লেখিত শৃংখলা পরিপন্থী ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধি লঙ্ঘনের কাজ করায় তিনি অপরাধ করেছেন মর্মে সিন্ডিকেট নিশ্চিত হয়েছে।
একাডেমিক দুর্নীতি করে তিনি থেমে থাকেননি অধ্যাপক ড. ফরিদ। তাঁর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করারও অভিযোগ আছে। পরীক্ষার ফলাফল উন্নীতকরণ এবং শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্রীদেরকে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া, ছাত্রীর সাথে অনৈতিক ই-মেইল আদান প্রদান, মেসেজ আদান-প্রদান, মধ্যরাতে ছাত্রীর সাথে দীর্ঘক্ষণ অডিও-ভিডিও কলে আলাপ করারও অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এ দিকে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও উচ্চ শিক্ষা গবেষণা নির্দেশনায় অনধিকার চর্চার চেষ্টা করেন অধ্যাপক ড. ফরিদ। তিনি অযোগ্য বিবেচিত হওয়ার পরও নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের পিএইচ.ডি. গবেষক সঞ্জয় কৃষ্ণ বিশ্বাসের গবেষণা তত্ত্বাবধান করেন। যা সুস্পষ্টরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থী। উক্ত গবেষকের ডিগ্রি প্রদানের বিষয়টি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের ২৪২ নং সভার (২৩ জুন ২০২২) ৪৮ নং
এজেন্ডাভুক্ত করা হয়। সভা অনুষ্ঠানকালে ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধানে ডিগ্রি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপিত হলে সভার সদস্যরা তীব্র আপত্তি জানান। ফলে তাঁর সুপারভিশনে পিএইচ.ডি. প্রদানের এজেন্ডা প্রত্যাহার করা হয়।
২০১২ সালে তিনি পুনরায় বিভাগে যোগদান করে আধিপত্য পুনরুদ্ধারে অনৈতিক চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করা হলে এই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নৃ-বিজ্ঞানের অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, চবির ইতিহাসে ড. ফরিদই প্রথম ব্যক্তি যাকে বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে; যা নজিরবিহীন ঘটনা। সভাপতির দায়িত্ব থেকে অপসারণ এবং পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রাখার শাস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের জন্য অপমানজনক এবং চরম লজ্জার। এরকম দুর্নীতিগ্রস্থ লোক এখন উপাচার্য হওয়ার জন্য দৌঁড়াচ্ছেন, একথা শুনতেই লজ্জা হচ্ছে আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এধরণের অনৈতিক ও গর্হিত কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিভাবে উপাচার্য পদপ্রত্যাশী হয়- প্রশ্ন রাখেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভিসি নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্যানেলে যেসব নাম থাকবে— তা থেকেই কাউকে মনোনীত করা হতে পারে বলেও জানিয়েছেন ইউজিসির এ সদস্য।