নব্বই দশকের কথাসাহিত্যিক মহিবুল আলম। জন্ম ১৯শে জানুয়ারি ১৯৬৯, সিলেটের গোবিন্দগঞ্জে। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মুরাদনগর সদরের কাজীবাড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর মহিবুল দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী। প্রায় সতেরো বছর নিউজিল্যান্ডে বসবাস করে বর্তমানে থিতু হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের গোল্ড কোস্ট শহরে। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তিথিক্ষয় ও আকাশগঙ্গা’। দ্বিতীয় গল্পের বই ‘নদীবান ও কষ্টের পাঁচ আঙুল’। প্রথম উপন্যাস ‘কাঁচাজল’। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে লেখা। এরপর প্রেম-ভালোবাসা, রাজনীতি ও ইতিহাস, নগর জীবনের বহুবিধ সংকট, প্রবাসজীবন ও ভ্রমণ নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘তালপাতার পুথি-১’ ও ‘তালপাতার পুথি-২’। যা পরবর্তীতে পরিমার্জিত অখণ্ড সংস্করণ বের হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনকেন্দ্রিক বিশাল পরিসরে রচিত এ আখ্যান সচেতন পাঠকমহলে অভিনন্দিত হয়েছে।
প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘তিথিক্ষয় ও আকাশগঙ্গা’র জন্যেই পেয়েছেন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার (১৯৯৮)। প্রবাসের বৈরিতা ও কর্মব্যস্ততায় প্রায় এক দশক বিরতির পর লেখালেখির জগতে ফিরেই বাংলাদেশ এসোসিয়েশন নিউজিল্যান্ড ইনকর্পোরেট ও বাংলাদেশ সোসাইটি নিউজিল্যান্ড ইনকর্পোরেট-এর যৌথ উদ্যোগে অকল্যান্ডে বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পান প্রবাসী সাহিত্যিক সম্মাননা পুরস্কার (২০১৩)। পরবর্তীতে ‘তালপাতার পুথি’ উপন্যাসের জন্যই পান ‘বাঙালি কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)’ ও ‘সাহিত্য দিগন্ত লেখক পুরস্কার (২০২০)’।
লেখক মহিবুল আলমের ২০২৩ সালটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ করেই কলকাতা থেকে পান ‘বরাহনগর দর্পণ সাহিত্য সম্মাননা’ ও ‘বিপ্লবী সংবাদ দর্পণ সাহিত্য সম্মাননা’, শিলিগুড়ি থেকে পান ‘চণ্ডাল বুকস সাহিত্য সম্মাননা’, আলিপুরদুয়ার থেকে পান ‘ক্রিয়েটিভ আইডিয়া সাহিত্য সম্মাননা’ ও ‘ডুয়ার্স সমাচার সাহিত্য সম্মাননা’। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন পাঠকের ভালোবাসা। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে অর্জন করেছেন বহুবর্ণিল অভিজ্ঞতা। আর সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে কেন্দ্র করে চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর সাহিত্য-সংগ্রাম।
মহিবুল আলম এর কাব্যগ্রন্থ “যেখানে নদী যায়” থেকে কবিতা
লাশবাহী কফিন
আমার মৃত্যু হলে আমার লাশটা আমি কাঁধে নিয়ে হাঁটবো।
আমার কফিনবন্দি লাশ। চারিদিকে লোবানের ঘ্রাণ। দক্ষিণের শিস দেওয়া বাতাস।
দুপুরের সন্ধিক্ষণে শেষে বিকেলের রোদটা যখন পুবের দেয়াল ঘেঁষে আড়াআড়ি
কামরাঙা গাছটার দেহ বেয়ে একটু একটু নামে-
আমি তখন লাশ নিয়ে কোনো একটা কবিতা লিখবো।
আমি লাশবাহী কফিনটা নিয়ে একাই হাঁটবো। একটা দিঘল বিকেল-
বিকেলের গায়ে বৃক্ষশোভিত একটা পথ। চারিদিকে পাখিদের কলতান।
লাশের শরীর বেয়ে ওঠা বিকেলের প্রশান্তির রোদটুকু ঝিকিমিকি আলোতে রাস্তায়
ক্রমাগত নৃত্য করবে। অসংখ্য ঝিঁঝিঁপোকা নিস্তব্ধতার সিঁড়ি বেয়ে নাকি সুরে ডাকবে-
আমি লাশ নিয়ে কোনো অবান্তর গান বাঁধবো।
আমি লাশবাহী কফিন কলার ভেলায় ভাসিয়ে সীমান্তের ওপারে যাবো।
সূর্য ডুবে গিয়ে সমুদ্রের যেখানে শেষ হয়। শরীরের যেখানে অপরিসীম গ্লানি-
তীরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভেতর ক্লান্তির চিহ্ন।
আমি লাশ নিয়ে বেহুলার গল্প ফাঁদবো। রূপবানের গল্পও।
আসলে রূপবানের বা বেহুলার গল্প অলীক।
আমি শ্রান্ত শরীরে জলের ভেতর পা ভিজিয়ে বলবো, লাশের রাজনীতিতে
রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো গল্পই হয় না। আমার লাশেরও না।
চালতার ভাঁজ
লেপটানো শরীরের বেগানা পুরুষে রাতের চুইয়ে পড়া জল
চটকে চটকে শুকোয় শুধরে নেওয়ার মতো।
যেন পুরুষের দেহে যুবতীর শরীর চালতারই ভাঁজ-
একটু একটু কষ্টে কষ্টে খোলে।
আদ্যঋতু কোন কালে ছিল শুধু যুবতীরাই জানে।
যেখানে নদী যায়
কোনো নদী কোমর ভিজিয়ে যদি যুবতীর বুক ছোঁয়া জলে ডোবে-
যুবতীরা যায় অন্য জনে। কুমড়োর খসখসে ডগার মতন চেহারার কোনো মহাজন
মধ্যবিকেলে নৌকোর গলুই বসে খুলতির টাকা গোনে- লাভে এক, লাভে দুই।
যুবতীরা গলা বাড়িয়ে নদীর জলে হাঁস খোঁজা খোঁজে- এই প্যাঁক প্যাঁক, এই প্যাঁক প্যাঁক।
মধ্যরাতে শিস দেওয়া সাপের মতন শকুন ডাকে, গাঙ পাড় ধরে যুবতীরা যায়।
এ যে শতবছর আগের গল্প। নয় দুয়ারের বারো উঠোন।
উঠোনের মাঝখানে পতপত করে ওড়ে যুবতীর সমস্ত শরীর। যুবতী শরীর শুকোয়।
মধ্যরাতে কুপি নিবে, মহাজন মরে যায়।
যেখানেই নদী যায়, যুবতীও যায় অন্যজনে।
মহাজনহীন খসে পড়া খুলতির টাকা গোনে কোনো কোনো যুবতী
ক্রমাগত হয়রান হয়, ভুলবাল গোনে- আবে এক, আবে দুই।