উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধিঃ গ্রাম বাংলায় এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। আগে নড়াইল জেলা ও উপজেলার গ্রাম এলাকায় বেশ দেখা যেত। সময়ের বির্বতন আর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আজ আমরা হারাতে বসেছি এ পাখিটি। উজ্জ্বল রায় নড়াইল জেলা প্রতিনিধি জানান, সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পী, স্থপতি ও সামাজিক বন্ধনের কারিগর বাবুই পাখি ও এর বাসা। তালগাছের কচিপাতা, খড়, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে নিপুণ দক্ষতায় বাসা তৈরি করত বাবুই পাখি। সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি মজবুত।প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ভেঙে পড়ে না। শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া যায় না। বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাসার ভেতরে থাকে কাদার প্রলেপ। বাবুই পাখির অপূর্ব শিল্পশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন- “বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়ুই,কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। -এই অমর কবিতাটি এখন এ দেশে তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের কবিতা পড়েই এখনকার শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখির শিল্পকর্মের কথা জানতে পারছে।
এখন আর চোখে পড়ে না বাবুই পাখি ও এর নিজের তৈরি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী। সরু চিকন পাতা দিয়ে তৈরি বাবুই পাখির বাসা আর দেখা যায় না। দেখা যায় না এর সামাজিক জীবন ধারাও। অভিজ্ঞ মানুষ মাত্রই জানে বাসা তৈরির পর সঙ্গি খুজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গি পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সাথী বানানোর জন্য কতই না করে এরা। পুুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণীয় করার জন্য খাল বিল ও ডোবায় ফুর্তি করে নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে।
বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হলেও কাঙ্খিত স্ত্রী বাবুইকে সেই বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলেই কেবল সম্পর্ক তৈরি হয়। স্ত্রী বাবুই বাসা পছন্দ করলে বাকি কাজ শেষ করতে বাবুইয়ের সময় লাগে চারদিন। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীন কাজ করে বাসা তৈরি করে। বাসার ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি আড়া তৈরি করে, সেখানে পাশাপাশি দুটি পাখি বসে প্রেমালাপসহ নানা রকম গল্প করে।
তারপর নিদ্রা যায় এ আড়াতেই। কী অপূর্ব বিজ্ঞানসম্মত শিল্প চেতনাবোধ তাদের! একটা সময় ছিল, একটি তালগাছে ঝুলে থাকত অসংখ্য বাসা। সে দৃশ্য বড়ই নান্দনিক এবং চিত্তাকর্ষক যা চোখে না দেখলে সে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এসব শিল্পকর্মের ছবি। ব্যবহার করে অনেক ক্যালেন্ডার তৈরি হতো। অফুরন্ত যৌবনের অর্ধিকারি প্রেমিক বাবুইয়ের যতই প্রেমই থাক, প্রেমিকার ডিম দেওয়ার সাথে সাথে প্রেমিক বাবুই খুঁজতে থাকে আরেক প্রেমিকা ।
পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে। ধান ঘরে ওঠার মৌসুম হলো বাবুই পাখির প্রজনন সময়। দুধ ধান সংগ্রহ করে স্ত্রী বাবুই বাচ্চাদের খাওয়ায়। এরা তালগাছেই বাসা বাঁধে বেশি। তালগাছ উজাড় হওয়ার কারণে বাবুই পাখি এখন বাধ্য হয়ে অন্য গাছে বাসা বাঁধছে। এক সময় দিনাজপুর জেলার ও উপজেলায় গ্রাম অঞ্চল গুলোতে প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত।
৮০র দশকে ফসলে কীটনাষক ব্যবহার করার ফলে আর মৃত পোকামাকড় খেয়ে বাবুই পাখির বিলুপ্তির প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। প্রকৃতির বয়ন শিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের কারিগর নামে সমধিত পরিচিত বাবুই পাখি আর তার বাসা এখন আর চোখে পড়ে না। এক শ্রেনীর লোক শিকার করছে বাবুই পাখি। অন্যদিকে খাঁচায় বন্দি করে বেচা কেনাও হচ্ছে এ পাখি। খোঁজ নিয়ে যানা গেছে একশ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহকরে শহরে ধনীদের কাছে বিক্রি করছে। গাছে গাছে এসব বাসা এখন আর দৃশ্যমান না হলেও শোভা পাচ্ছে শহরের ধনীদের ড্রয়িং রুমে।