একমলাটে দুই কবির প্রেমঃ পাঠ পরবর্তী বয়ান
এবারের একুশে বইমেলা ২০২০ এ বাংলাদেশের আশির দশকের কবি শাহীন রেজা ও কোলকাতার আাশির দশকের কবি সৌমিত বসুর যৌথ পারফর্মেন্স প্রকাশিত হয়েছে শিকড় প্রকাশনী থেকে। অগ্রজ দু’জন কবির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় আছে। ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলে সুবিধা একটা আছে। কবির গতি, প্রকৃতি ও লেখার সঙ্গে দ্রুত ভাব বিনিময় করা যায়।
আমি লেখার শুরুতে বয়ান করেছি এক মলাটে দুই কবির প্রেম। প্রেম মানে এবাদত।প্রেম মানে ধ্যান। প্রেম মানে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা। একজন কবি সচেতন ও সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙিতে তাঁর কালের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এই গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে কবি তাঁর প্রেম কে প্রতিষ্ঠা করেন। আর সে কারণেই কালের নানাবিধ সমস্যা, প্রকৃতির প্রতিশোধ, বস্তুর বিলীয়মান রূপ, ঐশ্বর্য ও ভবিষ্যৎ প্রবণতা নিয়ে কবি লিখে যান তাঁর সৃষ্টির আনন্দ। এই অবগাহনে কবি সব সময়ই নিজের চিন্তার মাঝে তাঁর স্বপ্নকে গ্রোথিত করেন। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, কবির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত রহস্যময় সৃজনী-প্রতিভাই কি শেষ কথা? কবির এই সৃষ্টি সম্ভার, কবির অস্তিত্ব, বিচিত্র সম্পর্কের দৃশ্যমান বা অদৃশ্য যেসব ভাবনা থেকে কবি স্বপ্ন ছেঁকে আনেন, সেখানে কবির প্রতিভার যে বিশাল উন্মেষ তা কি নিতান্তই ঠুনকো?কস্মিনকালেও তা নয়, ব্যক্তি প্রতিভার মধ্যে দিয়ে আসলে একজন কবি সামষ্টিক অভিপ্সা ,রীতি-পদ্ধতি আর যে রঙ ছড়িয়ে দেন বিশ্বময় তার আলোতে রোশনিতে পৃথিবী হয় সুষম। মানুষের চিত্তে জাগে অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি। যা একজন সাধারন পাঠক ভাষা দিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা। তাইতো পাঠক বারেবারে ফিরে ফিরে কবিতার দুয়ারে কড়া নাড়ে।অতৃপ্ত আত্মার প্রশান্তির শ্রী বৃদ্ধি করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
০১.
অনুভূতির চুম্বনে দুই কবির কবিতাঃ
যেহেতু একমলাটে দুই কবির কবিতা। আমরা প্রথমে নজর দেবো শব্দের আদর আর ভাষার ঠাসবুননের দিকে। কবিদের কবিতা কখন জনপ্রিয় হয়? যখন ভাষার ঠাসবুননে শব্দের আদরের আতিশয্যে পাঠক বিমোহিত হয়ে যায়। একটি গ্রন্থ পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয় তার নিজস্ব ক্ষমতা বলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লাইব্রেরি ‘ প্রবন্ধে লিখেছেন, ” বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে।কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে,জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে।কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে।অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবলএক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে”।(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪০টি প্রবন্ধঃ নিত্যপ্রিয় ঘোষ,পৃষ্ঠা ১৯)। বাংলাদেশের আশির দশকের কবি শাহীন রেজা ও কোলকাতার আশির দশকের কবি সৌমিত বসু একটি বই যৌথভাবে প্রকাশ করে একটি সাঁকো বেঁধেছেন।সেই সাঁকোর দুটি কবিতা আমরা লক্ষ্য করিঃ
১.সহস্র উঠোন থেকে ধুলো কুড়িয়ে এই তোমার জামার
পকেটে রাখলাম
পকেটটা একটা পাখি হয়ে গেল।
এখন আমাকে বলো, পকেটে যদি পাখি রাখি
তাহলে কি হারিয়ে যাওয়া ধুলোগুলো ভেসে বেড়াবে
উঠোন জুড়ে।
যদি তাই হয়,তাহলে কত সমুদ্র জল ঐ পকেটে ঢাললে
হারিয়ে যাওয়া ভাই হেঁটে এসে বাইরের গ্রীলে হাত রাখবে।
(মা,স্টিফেন হকিং ও ভাইঃ সৌমিত বসু,পৃষ্ঠা ০৫)
২. শুয়ে আছে রোদগুলো, মাড়িয়ে দুপুর
আমি যাচ্ছি হেঁটে, দুই পায়ে ঝরাপাতার নূপুর
একফালি মেঘ নিয়ে চুলে
তুমিও ঘুঘুর ডাকে স্মৃতিটুকু ভুলে,
এসেছ কি?
………………………
কতো যত্নে তারই বুকে আমারই সে নাম
ভুল করে ভুলে যাওয়া ধূধূ পথ ধরে
এসেছ কি ভুল চাঁদ পৌষের ঘরে?
(এসেছ কি ভুল চাঁদ পৌষের ঘরেঃ শাহীন রেজা,পৃষ্ঠা ৫)
এক মলাটে দুই কবির এই দুটিই প্রথম কবিতা। লাইব্রেরি হচ্ছে বইয়ের সাঁকো। সাঁকোতে অনেক বই থাকে। কবিতার শরীরের দিকে তাকাই। কি বলতে চাইছেন সৌমিত বসু আর শাহীন রেজা? বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আশির দশক কেমন ছিলো? যে দশকে এই দুজন বেড়ে উঠেছেন। সৌমিত বসুর কবিতাটি ম্যাজিক রিয়ালিজমের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। আর শাহীন রেজার কবিতা চিরায়ত বাংলার রূপের বর্ণনা ঢঙের মধ্যে একটা মেসেজ দিয়েছেন। সেই মেসেজটা হলো প্রেম। সৌমিত বসুর কবিতাটির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা প্রসূত দিক আছে। হারিয়ে যাওয়া কোনো আপনজন কি ফিরে আসবে জাদুবাস্তবতার জগতের পর্দা সরিয়ে! শাহীন রেজার এই ভুল চাঁদ কি কোনো প্রেয়সী? নাকি এই চাঁদও কোনো পরম আকাঙ্খিত সুহৃদ! দুজন কবিই প্রথম কবিতার মধ্যে একটা রহস্যময় চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন নিজস্ব ভাষার ঢঙে। কবিতার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। আবছা আলোয় যে অস্পষ্ট রঙ দেখা যায় কবিতার অবয়বে সেটাই কবিতা।
০২.
কবিতার ভাষা নির্মাণে দু’জন কবিই কোনো অভিধানের দুয়ারে কড়া নাড়েননি। সচরাচর যে শব্দগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলোকে নিয়েই তাঁরা কাব্যের শিখা জ্বালিয়েছেন। ভালোলাগার একটা ডিসকোর্স হৃদয়ে জেগে ওঠে এখান থেকেই। তাঁদের কবিতার রস আস্বাদনে আমাদের কোনো কষ্ট করতে হয়না। অনেক এলোমেলো শব্দের ঝনঝন ঝমঝম ঝিকঝিক নেই। সৌমিত বসু যখন ‘শাস্তি ‘ কবিতায় বলেনঃ
“তুমি না জাগালে আমি ঘুমিয়ে থাকতাম সারাটাজীবন।
শুয়ে থাকতাম গর্ভের আড়ালে এই এতটুকু হয়ে
তখন আমার নুনমাখা ঘর আর গাছের বাকল থেকে
বেরিয়ে আসছে
নিমফুলের গন্ধ, গতজন্মের সমস্ত সম্পর্ক দু-চোখে মেখে
ঘুমিয়ে থাকতাম আমি বছর পেরিয়ে মাস,মাস পেরিয়ে বসন্ত।” (শাস্তি, পৃষ্ঠা ১৫)
আবার শাহীন রেজা “এই যাওয়া শেষ যাওয়া নয়” কবিতায় লিখেছেনঃ
“তুমি তো জানতে এবং বলতেও এই যাওয়া মানে শেষ যাওয়া নয়,
তবে কি ফিরে আসবে কোনোদিন?
ফিরে আসতে আসতে তোমার সেই চিরচেনা কন্ঠ বাতাসে
ভাসাবে শব্দের ফুল,শিশিরের ডানায় ডানায় কেবল মুগ্ধতা
তুমি তো ফিরবেই একদিন;ফেরার পথে তোমার কলম হবে
মেঘ আর কবিতার ক্যানভাস শুধুই সু-নীল।”
(এই যাওয়া শেষ যাওয়া নয়, পৃষ্ঠা ১৬)
তুমি কেন্দ্রিক দুই কবির দুটি কবিতা। চিত্র এঁকেছেন আলাদা মেজাজে। বিষয় আলাদা। সৌমিত বসুর শাস্তি কবিতাটির ‘তুমি’ আসলে কে? ঈশ্বর? নাকি মা? তিনি যখন অবলীলায় বলেন,”তুমি না জাগালে আমি ঘুমিয়ে থাকতাম সারাটা জীবন”…. তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে।কবি যে চেতনা থেকে এই ‘তুমি’ সৃষ্টি করেছেন তা আত্মার আত্মীয়। মা’ই ঈশ্বর আবার ঈশ্বরই মা। আশ্চর্য সুন্দর একটি পংক্তি। আধুনিক কাব্যের ভাষা সৃষ্টিতে নিরলস অনুশীলন প্রশংসার যোগ্য। সৌমিত বসু থেকে শাহীন রেজার দৃষ্টিভঙি আলাদা। কবি শাহীন রেজার ‘তুমি’ আসে অন্য সৌন্দর্য ও উপলব্ধি থেকে। শাহীন রেজা যখন লিখেন,”তুমি তো জানতে এবং বলতেও এই যাওয়া মানে শেষ যাওয়া নয়”….. তখন স্পষ্ট হয়ে যায় এমন এক বিষয়, যাঁর সঙ্গে শাহীন রেজার উত্তরাধিকার সম্পর্ক আছে। হয়ত সেই আত্মা কবিকে ছেড়ে চলে গেছে চিরতরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। দুজনের ‘তুমি’ আলাদা হলেও সুক্ষ্ম প্রশান্তি আর পবিত্র বেদনা লুকিয়ে আছে। দুজনেই এখানে প্রেমের আর্তিকে পরিস্ফুট করে তাকে মানবিক করে তুলতে চেয়েছেন। শব্দের আদর যেন ছিটিয়ে দেয়া আছে কবিতার পংক্তিগুলোতে।
০৩.
ভাষার খোঁজেঃ
রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত অন্য কবির পক্ষে নতুন ভাষা সৃষ্টি করা ছিল সুকঠিন, তারও চেয়ে কঠিন ছিল নতুন ভাষা ও ভাবের জগতে পাঠক সাধারণকে সহজ বিশ্বাস নেবার অবসর দেয়া। ডঃ বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ” জীবনানন্দ সেই কঠিন ব্রতই গ্রহণ করেছিলেন এবং সাফল্যও অর্জন করেছিলেন তাঁর প্রমাণ তাঁর সমসাময়িক ও অব্যবহিত পরবর্তী কবিদের উপর তাঁর রচনার প্রভাব। আধুনিক কবিদের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দ দাশেরই নাম করা যেতে পারে যিনি নিজের একটি জগৎ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। পৃষ্ঠা ১৮৫”…। জীবনানন্দ দাশ এমন একটা ঘোর লাগা ভাষা সৃষ্টি করেছেন যার রেশ দশকের পর দশক ধরে বাংলা কবিতার জীবনানন্দ পরবর্তী কবি সমাজ মনের অজান্তেই অনুসরণ করেন। তারপর চর্চার মধ্যে দিয়ে নতুন ভাষা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে অগ্রজ কবি বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ ‘ গ্রন্থে লিখছেন,” আমাদের সময় শক্তির কবিতা জীবনানন্দ আক্রান্ত ছিল সবচেয়ে বেশি, একথা বলা হয়।আমার ‘ফিরে এসো চাকা’য়ও এই প্রভাবের কথা কেউ কেউ বলেন। তবে আমার মনে হয় তা খারাপ নয়। অগ্রজকে অস্বীকার করে কিছুই সম্ভব নয়। আর ধর্মগ্রন্থে আছে যে,’কে কতবড় গুরু তার বিচার হয় শিষ্যদের দিয়ে’।এই প্রভাব তবে তো আনন্দের। আমি প্রথম দিকে জীবনানন্দের ভাষা নকল করে কবিতা লিখতে চাইলাম। যেরকম কবিতা ‘স্বাধীনতা ‘পত্রিকার পূজো সংখ্যায় প্রকাশিতও হয়েছিল। তাঁর একটি লাইন এরকম, ‘পৃথিবীর ডাকে আজ কন্যারা জাগেনা’। পরে অবশ্য আমি জীবনানন্দ প্রভাব ছাড়িয়ে অন্যরকমভাবে লিখতে চাইলাম”।( পৃষ্ঠা ৩৯)।
১.আষাঢ়ের সব রঙ মুছে গেলে একদিন
ভালোবাসার ঢঙে জেগে থাকে শুধুই শ্রাবণ
(স্মৃতির নিজস্ব ঠোঁটেঃ সৌমিত বসু, পৃষ্ঠা ৩১)
২.রাত্রির ডানা ধরে এখন শুধুই চন্দ্র -যাত্রা
ঘুম-ডাকে ইশারা ডাহুক পথের
(আহা রাত্রিঃ শাহীন রেজা, পৃষ্ঠা ১২)
আশির দশকের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কবি। তাঁদের ভাষা চর্চায় জীবনানন্দ এসেছেন। আবার আধুনিক কবিতার সর্বশেষ যে প্যাটার্ন সেই নিরিক্ষাও এসেছে। অর্থ্যাৎ অনুভূতির আবেগের চিন্তার যেটা বিশুদ্ধতম নির্যাস,সেটা কবি সৌমিত বসু ও কবি শাহীন রেজার কবিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁদের কবিতা সমকালীনতাকে অতিক্রম করে সার্বজনীন হয়ে হাজির হয় পাঠকের দুয়ারে। কবিতা ব্যক্তি বিশেষ ও যুগ্মবিশেষে সৃষ্টি হলেও আবহমান মানব সভ্যতার ফসল। কারণ কবি যুগের অভিজ্ঞতা আবহমান মানবসভ্যতার অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়,পরিস্রুত হয় এবং শেষে একটি বিশেষরূপ গ্রহণ করে। তাই মহৎ কবিতায় আমরা কবির কন্ঠস্বরের সঙ্গে যুগের কন্ঠস্বর ও আবহমান মানবসভ্যতার কন্ঠস্বর ধ্বনিত হতে শুনি। ফলে পাঠকের মনের ওপর তার প্রভাব অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠে। কবি শাহীন রেজা ও কবি সৌমিত বসুর যৌথ পারফর্মেন্স কবিতাগ্রন্থ পাঠে আমার অনুভূতির দরোজায় এটাই অনুভূত হয়েছে। ##