হাফিজুর রহমান শিমুলঃএদেশের আনাচে কানাচে এমনও অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি আছে যারা অর্থের অপ্রতুলতার কারনে সমাজে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরও চাকুরী যোগাড় করতে না পেরে এখনও চিরকুমার রয়ে গেলেন। একটু সহযোগীতা পেলেই হয়তো তিনি হতে পারতেন বড় কোন কর্মকর্তা। অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছেন অগোচরে।
তেমনই একটি নাম হারান কুমার চন্দ্র। সবাই তাকে নাপিত হারান দা নামেই চেনেন, বয়স ৬৩ বছর। শিক্ষাগত যোগ্যতা বি.কম. পাশ। তারপরেও কালিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলা এলাকায় ৩০ বছরের অধিক সময়ে একটা টিনের ছাউনি ও বেড়া দেয়া ঘরে নাপিতের( নরসুন্দর) কাজ করে সংসার চালান।
১৯৫৭ সালে তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের সাতক্ষীরার জেলাধীন কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর গ্রামে হারান চন্দ্রের জন্ম। পিতা মৃত অনিল চন্দ্র ও মাতা মৃত গৌরি রানী। পিতা-মাতার তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে হারান চন্দ্র সবার বড়।
হারান চন্দ্র ১৯৬৯ সালে ধুলিয়াপুর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বানিজ্য বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেন। তারপর পড়ালেখার জন্য ছুটে যান খুলনায়। খুলনা কমার্স কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে খুলনা কর্মাস কলেজ থেকে বানিজ্য বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন। এখানেই থেমে যাননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কয়েকবছর এলাকায় নাপিতের কাজ করেন। আবার উচ্চাভিলাষ জাগে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের। পুনরায় খুলনা কমার্স কলেজে বি.কম. কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৮৬ সালে তিনি খুলনা কর্মাস কলেজ থেকে বি.কম. পাশ করেন।
হারান দা এখনো চিরকুমার। বিয়েই করেন নাই। পিতা-মাতা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়ের সংসারে থাকেন। অনেক কষ্ট করে নাপিতের কাজ করার অর্থ দিয়ে ভাইপো- ভাইঝিদের পড়াশুনা করিয়েছেন। নিজে ওদেরকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন।
হারান দা বলেন, শিক্ষার মধ্যে যে মজা পেয়েছিলাম সেটা এখনো আছে। আমার কিছু ছাত্রছাত্রী আছে। অবসর সময়ে নামেমাত্র সামান্য কিছু টাকা নিয়ে তাদেরকে প্রাইভেট পড়াই। মূলত আত্নতৃপ্তির জন্য এই কাজটি করি।
“চাকুরী করেন নাই কেন?” এমন প্রশ্নের জবাবে হারান দা বলেন, বি.কম. পাশ করার পর নায়েবের চাকুরী হয়েছিল, কিন্তু অর্থের অপ্রতুলতার কারনে বাবা ঘুষের টাকা দিতে পারেন নাই। তাই চাকরিটা আর করা হলো না।
“বিয়ে করেন নাই কেন?” এমন প্রশ্নের জবাবে হারান দা বলেন, অসুস্থ্য বাবা-মায়ের খেদমত করতে করতে কখন যে সময় পার হয়ে গেছে টের পাই নাই। তাছাড়া বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ভাইপো-ভাইঝিদের মানুষ করতে সময় কেটে গেছে। বুঝতে পারি নাই।
হারান দা কখনো কারো কাছে কষ্টের কথা শেয়ার করেন না। করোনা ভাইরাসের কারনে তার নাপিতের ব্যাবসা প্রায় বন্ধ। তাছাড়া প্রাইভেট পড়ানোও বর্তমানে বন্ধ আছে। তাই এই বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্টে জীবনধারণ করতে হচ্ছে হারান দা কে। তারপরেও। হারান নাপিত কে দেখে কেউ তার কষ্ট বুঝবে না। সবসময় সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলেন।
শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারনে হারান দা এর মত প্রতিভাবান ব্যক্তিরা সমাজে আলো ছড়াতে পারেন নাই। হতে পারেন নাই সমাজের কর্তা ব্যক্তি। অথচ সমাজের উচ্চবিত্তদের একটু সহযোগীতা পেলে হারান দা এর মত লোকেরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতো। দেশ ও সমাজকে আলোকিত করতে পারতো।
আসুন হারান দা এর মতো প্রতিভাবান মানুষদের পাশে একটু সহযোগীতার হাত বাড়াই।