বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৮ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম:
গণমাধ্যমের অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় সভা আয়োজনসহ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জনাব বাহারুল আলম নতুন সিইসি নাসির উদ্দীনের পরিচয় কালিগঞ্জে আছিয়া লুতফর প্রিপারেটরি স্কুলে মা সমাবেশ অনুষ্ঠিত সলেমান মামুন ব্যারিস্টার সুমন দুই দিনের রিমান্ডে ডিএমপির ৩৮তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন শেখ মোঃ সাজ্জাত আলী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা আলেমরাই এক দিন এদেশে নেতৃত্ব দেবেন।।ধর্ম উপদেষ্টা কে এই নতুন ডিএমপি কমিশনার? দৌলতপুরে বসতবাড়িতে ডাকাতির সময় মা-ছেলেকে হত্যার দায়ে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ

গোয়েন্দা- মাহবুব সেতু

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০২০, ৪.৩৮ এএম
  • ২৯৪ বার পঠিত

হিরণ্যাক্ষ সোম৷ শখের গোয়েন্দা৷ ছিলাম৷ এখন আর নেই৷ ‘শখের’ বললাম বটে, কিন্তু বর্তমানের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তখন ছিল না৷ ও পথ ধরেছিলাম পেটের দায়ে, গত্যন্তর না পেয়ে৷ প্রাইভেটে পড়াতাম সোমেনকে, ওর কাকাই বাৎলেছিল এই রাস্তা— ‘প্রাইভেট টুইশন ছেড়ে প্রাইভেট আই হয়ে যাও হে, চেহারাটা কাটাকাটা, ঝকঝকে চোখমুখ, লেগে পড়ো ইয়ংম্যান৷ ছেড়ে দিতে কতক্ষণ?’

নামটাও দিয়েছিল সোমেনের কাকাই৷ ওটা আসল নাম নয়৷ আসল নামটা বলতে বাধা আছে৷ গোয়েন্দাদের একটা অফিস লাগে৷ আমার ও বালাই ছিল না৷ মোবাইল নম্বরে ফোন করলে আমিই গিয়ে হাজির হতাম মক্কেলের কাছে৷ নম্বর জানতে চাইবেন না৷ ওটা বদলেছি৷ কারণ ছিল৷ মক্কেল বলতে জুটেছিল অবশ্য একজনই৷ তবে তাই যথেষ্ট৷ সব অর্থেই, মোটা টাকা, বিপদের ঝুঁকি৷ কি করে যে এমন মালদার পার্টি আমার খোঁজ পেল জানি না৷ ভাগ্যের অনেক বিড়ম্বনা মুখ বুঁজে সয়েছি, কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করিনি৷ ভাগ্যের এই আকস্মিক সুপ্রসন্নতাও চোখ বুঁজে উপভোগ করেছি৷
বিরাট একটা বাগানবাড়ি৷ এককালে কোনো জমিদারের বিলাসভবন ছিল সন্দেহ নেই৷ শুক্রবার ফোন পেয়েছিলাম, হাজির হলাম রোববার বিকেলে৷ শুক্রবার বিকেলেই হাজির হতে পারতাম৷ কিন্তু সোমেনের কাকা বলেছিল ফোন পাওয়ামাত্র হাজির হলে দর পড়ে যাবে মক্কেলের কাছে৷ তাছাড়া কাজটা তেমন জরুরী কিছু নয়৷ বাড়ির কিছু দরকারী কাগজ বাড়ির কোথায় যেন লুকিয়ে রাখা আছে, সেটা আমায় খুঁজে বার করতে হবে৷ প্রথমে মাথায় ঢোকে নি৷ যাদের বাড়ি তারা যদি খুঁজে না পায় তবে আমি কি করে পাব? আমাকে তো বাথরুমে যেতে হলেই বাড়ির লোককে জিজ্ঞাসা করতে হবে! না, তা নয়, একটা নাকি গোপন নির্দেশ আছে, সেটা কোনো সাংকেতিক ভাষায় লেখা৷ কোনো খামখেয়ালী পূর্বপুরুষের কাজ৷ বহুদিন এমনিই পড়েছিল৷ এখন হঠাৎ গৃহকর্তা সংকেতের রহস্য ভেদ করতে চান৷ আরেব্বাস্, এ তো পুরো শার্লক হোমস কি ফেলুদার কেস! কত দেবে বলছে? দু’ হাজার৷ অ্যাঁ, মোটে দু’ হাজার? আমি ওদের কোটি টাকার গুপ্তধন উদ্ধার করে দেব, আর আমাকে দেবে মাত্র দু’ হাজার? না, না, এটা আগাম! সফল হলে আরও তিন দেবে৷ আর কোটি টাকার গুপ্তধন নয়, একটা মামূলী ডায়েরী৷ পারিবারিক স্মৃতিটৃতি কি সব লেখা৷ আর না পেলে? যাতায়াতভাড়া, ওই কদিনের থাকা খাওয়া, আর ওই আগামটা তো আছেই৷ মন্দ কি! কলকাতার এঁদো গলিতে বাড়ির লোকের মুখ ঝামটা খাওয়ার চেয়ে বড়লোকের বাড়িতে এক সপ্তাহ রাজার হালে থাকা৷ সঙ্গে দু’ হাজার টাকা, হ্যাঁ, ওই শেষের তিন হাজারের লোভ না করাই ভালো৷
বাড়িটা যতটা জমকালো গৃহকর্তা ততটা নন৷ বেঁটেখাটো মানুষটা শুধু বাড়িটার সঙ্গেই নয়, পরণের dressing gown-টার সঙ্গেও যেন কেমন বেমানান৷ একটা মৃদু ঔদ্ধত্য আছে বটে, কিন্তু সেটা যেন বংশমর্যাদা রক্ষার দায়ে৷ এমনিতে ভদ্রই, গোবেচারা বললেও ভুল হয় না৷ পৈত্রিক সম্পত্তির জোরেই চলে৷ শহরতলীর দিকে কি একটা সিনেমাহলেরও মালিক৷ আরও কিছু আইনী-বেআইনী কারবারও হয়তো আছে, কে জানে! নইলে একটা ফালতু ডায়েরী খুঁজতে দু’ হাজার টাকা গচ্চা দেয়? কে জানে কি আছে ডায়েরীতে!
‘আপনিই হিরণ্যাক্ষ সোম? প্রাইভেট আই?’ বেশ সম্ভরম হল নিজের ওপর, সম্বোধনটা শুনে৷ এই রকম সময়ে শার্লক হোমস বা ফেলুদা হলে কি করতেন? বলা কঠিন৷ তাঁদের নিজের একটা অফিস ছিল নিজের বাড়িতে৷ নিজের ডেরায় বসে মক্কেলের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে যতটা স্মার্ট হওয়া যায়, এখানে মক্কেলের বাড়িতে এসে তা হওয়া কঠিন৷ তাছাড়া কেমন একটা ভয় ছিল যে আমার নামটা শুনে যতটা মনে করেছিলেন, হয়তো চেহারাটা দেখে নিরাশ হয়েছেন৷ অমূলক ভয়৷ আমি আসাতে উনি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত বোধ করছেন৷ একটা মামলার কাজে ডায়েরীটা দরকার৷ পেতেই হবে৷ সাংকেতিক লিপির কথা যেটা শুনেছিলাম, সেটাই৷ বাংলা আর ইংরাজী হরফে মিশিয়ে লেখা৷ আমাকে দেখাবেন রাতের খাওয়ার পর৷ আমার নিশ্চয়ই আমিষে আপত্তি নেই?
আপত্তি আমার আমিষ-নিরামিষ কিছুতেই নেই৷ খালি একটু তাড়াতাড়ি সেটা এলে ভালো হয়৷ পেটটা স্রেফ চুঁই চুঁই করছে৷ কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলা যায় না৷ দরকার অবশ্য হল না৷ এক গ্লাস ফলের রস, এক প্লেট কাজুসমভিব্যাহারে রেকাবি-বাহিত হয় এসে হাজির৷ আমার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? একটু বিবেক দংশন হচ্ছিল৷ একটু ভয়ও৷ ডায়েরী খুঁজে না পেলে (পাওয়ার কোনো আশা দেখছি না) শেষ্টা কাজু আর ফলের রসসিক্ত অতিথিবাৎসল্য কি বিপরীত রূপ নেবে কে জানে? কিন্তু ক্ষুধার দংশনে বিবেক দংশন চাপা পড়ে গেল৷ ডায়েরী না পেলে আমি তো আর শেষের তিন হাজার চাইছি না! বিবেকসমস্যার নিষ্পত্তির আবেগে বোধকরি কাজু ও ফলের রস ভদ্রজনোচিত সময়ের আগেই অন্তর্ধান করেছিল৷ সেটা ভদ্রলোকের চোখ এড়ায়নি৷ আরেকটু দিতে বলব? গালের ত্বকের ভিতরে একটা গরম আভা বোধ করলাম৷ না না, ঠিক আছে, thank you! হোমস বা ফেলুদা হলে প্রথমেই এরকম কাঁচা কাজ করতেন না৷ কিন্তু তাঁদের রেটও নিশ্চয় বেশী হত৷
গ্রামের দিকে সন্ধ্যা হয় তাড়াতাড়ি৷ বাগানবাড়িটা কেমন যেন গা ছম্‌‌ছমে লাগছে৷ বিদ্যুৎ অবশ্য আছে৷ বসার ঘর আর খাবার ঘর দুটোই রীতিমতো আলোকিত৷ কিন্তু ওই বড় বড় সেকেলে জানালাগুলোর বাইরে কেবল জমাটবাঁধা অন্ধকার৷ জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে অসংখ্য জোনাকি পুঞ্জে পুঞ্জে জ্বলছে নিভছে৷ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে ঘোর লাগে, যেন বহু উপর থেকে একটা বিশাল রহস্যময় নগরীর দিকে চেয়ে আছি৷ জোনাকিগুলো যেন অসংখ্য গবাক্ষপথে আলোর ঝিকিমিকি৷ একটা অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন সচলতার বহুদূরাগত ইঙ্গিত৷ কি যেন একটা রহস্যময় কর্মব্যস্ততা চলছে গোপনে গোপনে৷ কোনো এক অজানা যুদ্ধের প্রস্তুতি৷
রাতের খাবারের আয়োজনে অভিনবত্ব ছিল৷ মাটিতেও নয়, টেবিলেও নয়৷ খাটো খাটো জলচৌকিতে থালা রেখে খাওয়া৷ জাপানী রীতি৷ কোন এক পূর্বপুরুষ জাপান গিয়েছিলেন, সেই থেকে এই কায়দা চালু করেছিলেন৷ না, ইনি সেই ডায়েরীলেখক পূর্বপুরুষ নন, তাঁর বড়ভাই৷ এই রকম রীতি নাকি পশ্চিমে খানদানি মুসলমানদের মধ্যেও আছে৷ অবশ্য আমি চাইলে টেবিলে বসেও খেতে পারি৷ না, না, জাপানী কায়দায় খেতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই, বিশেষতঃ খাবার যেখানে উপাদেয়৷ কিন্তু ভদ্রলোক আমার আপত্তির কথা এত বার জিজ্ঞাসা করে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছেন৷ একবারও আপত্তি না করাটা ভদ্রজনোচিত হচ্ছে তো?
খিদে পেয়েছিল বেজায়৷ খাওয়াটাও হল অসাধারণ৷ কিন্তু মন যেন ভদ্রলোকের উপর ঠিক প্রসন্ন হতে পারছিল না৷ কি গুণ আছে লোকটার? স্রেফ পৈত্রিক সম্পত্তির জোরে চালাচ্ছে! মক্কেলের সম্বন্ধে হোমস বা ফেলুদার এই ধরণের মনোভাবের কথা শোনা যায় না৷ কিন্তু তাদের জীবনে অভাব ছিল না, আর তাছাড়া তাদের মনের সব কথা কি আর ওয়াটসন বা তোপ্‌‌সে লিখতে পেরেছে? গোয়েন্দার জীবনকাহিনী লেখা দায়িত্ব তাই একজন গুণমুগ্ধ সহকারীর উপর থাকাই ভালো৷ অভিনেতা নিজে সমালোচক হলে মঞ্চের কথা লিখতে সাজঘরের কথা লিখে বসে৷
বেশ ঘুম আসছিল৷ ভোজনের বিলাসিতা দেখে মনশ্চক্ষে এর পর একটা দুগ্ধফেননিভ শয্যার ছবি ভাসছিল৷ কিন্তু আসল কথাটা ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিলেন৷ সাংকেতিক লিপি৷ সেটা শোবার আগেই দেখাবেন উনি৷
একটা সাদামাটা কার্ডে কিছু বাংলা ইংরাজী হরফ লেখা দুই লাইনে৷ মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷ একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি যে এর সঙ্গে ডায়েরীর কোনো যোগ আছে এমন মনে করার কারণ কি? তারপর ভাবলাম যে সেটা নিশ্চয়ই খুব কাঁচা প্রশ্ন হবে৷ হাজার হোক, আমিই কিনা গোয়েন্দা! হোমস হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আতসকাঁচ বার করে সাংকেতিক লিপির লেখকের জন্মতারিখ অব্‌‌ধি বলে দিত৷ আতস কাঁচের কথায় মনে পড়ল, ওই বস্তুটি আমার ব্যাগেও আছে৷ ঝকঝকে তীক্ষ্ণ চোখ আর আতস কাঁচ—এ ছাড়া গোয়েন্দা হওয়া চলে না৷ বাপ-মার কল্যানে ঝকঝকে চোখ আমার আছে, বেশ ঘুম পেলেও সে দুটোকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে বাগিয়ে রাখারও চেষ্টা করছি৷ আর আতস কাঁচটা জোগাড় করেছিলাম চৌরঙ্গীর ফুটপাথ থেকে৷ সেইটা দিয়ে গম্ভীর মুখে কাগজটার দিকে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে রইলাম৷ আর কেমন যেন মনে হতে লাগল ভদ্রলোক ততোধিক তীক্ষ্ণভাবে আমার কার্যকলাপ লক্ষ করছেন৷ সেটা আমার আত্মপ্রত্যয়ের অভাবজনিত ভ্রম নাকি সত্য, তা কে বলবে!
ফাউন্টেন পেনের কালিতে লেখা৷ গোটা গোটা হরফ৷ ইংরাজী অক্ষরগুলো সবই বড়হাতের৷ কাগজের উপরের ডানদিকে সামান্য কালির দাগ৷ যেন ওইখানে কাগজটাকে আঙুল দিয়ে চেপে ধরা হয়েছিল লেখার সময়ে৷ কিন্তু তাতে কি এসে যায়? হঠাৎ মনে হল এর একটা চলনসই ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে লেখক বাঁহাতি, ডান হাতে কাগজটা চেপে ধরে বাঁহাতে লিখেছে৷ বাঃ, এইটা বেশ একটা গোয়েন্দাসুলভ মন্তব্য হতে পারে৷ খাবার সময়ে লক্ষ করেছি ভদ্রলোক নিজেও বাঁহাতি৷ এখন দেখা যাচ্ছে পূর্বপুরুষও বাঁহাতি৷ তাতে অবশ্য ডায়েরীর হদিশ কিছু মিলছে না, কিন্তু এই অস্বস্তিকর নিরীক্ষণপর্বটার ইতি তো টানতে হবে একটা জুৎসইভাবে৷
‘এটা বোঝাই যাচ্ছে যে আপনার সেই পূর্বপুরুষ বাঁহাতি ছিলেন’, বলি আমি, ‘কারণ লেখার সময়ে তিনি ডান হাতের আঙুল এখানে রেখেছিলেন৷’
ভদ্রলোক কেমন থতমত খেয়ে গেলেন৷ ‘না না, ওটা তো পূর্বপুরুষ লেখেন নি৷ ওটা লিখেছি আমি, এই একটু আগে, আপনাকে দেখাব বলে৷ লেখাটা একই, তবে মূল লেখাটা আছে একটা জরাজীর্ণ খেরোর খাতায়৷ সেটা সবসময়ে বার করা মুস্কিল, তাই৷’ আমি কি সেই মূল লিপিটা দেখতে চাই?
আলবৎ, অবশ্যই৷ মূল লেখা না সূত্র-টুত্র পাব কি করে, যাকে বলে clue? কিন্তু তাহলে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ আমার আপত্তি নেই তো?
দিল তো রাতের ঘুমটা নষ্ট করে! শেষ পর্যন্ত যে বেইজ্জৎ হতেই হবে সেটা ভেবেই এসেছিলাম, কিন্তু একবার লিপিটা দেখার পর পাঠোদ্ধারের দুষ্করতা এবং তার পর একটা অজানা লাঞ্ছনার অনিবার্যতা– এই দুটো অতিমাত্রায় প্রকট হয়ে ঘুম আসার সব সম্ভাবনাই দিল মাটি করে৷
মাঝারি মাপের ঘর৷ একধারে ছোটো খাট৷ পায়চারি করার জায়গা অনেকটাই৷ পায়চারি করেই গেল অনেকটা সময়৷ চিন্তাগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে৷ এত বড়লোক বাড়িতে থাকি নি কখনো৷ চারিদিকেই কেমন যেন বিলাসিতার চিহ্ন৷ কি হয় বিলাসিতা করে? যাদের এত টাকা তারা কেন একটা তুচ্ছ ডায়েরী খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে? কি আছে ওতে? নাকি এটা একটা খামখেয়ালীপনা? মোটে দু’ হাজার টাকা দামের এক ধরণের বিলাসিতা? হয়তো এরা সবই বুঝতে পারছে৷ বুঝছে যে আমার নাম হিরণ্যাক্ষ সোম নয়, আমার গোয়েন্দাগিরি করার কোনো এলেম নেই৷ হয়তো এও বুঝছে যে আমি কত অসহায়, বিপন্ন বোধ করছি৷ বুঝছে, আর বুঝে মজা পাচ্ছে, দু’ হাজার টাকা দামে কেনা মজা৷ আমার কাছে ওই টাকাটা অনেক, ওদের কাছে কিছুই না, তাই—৷ ডায়েরী খুঁজতে কখনো সাংকেতিক লিপি লাগে?
একটা ঘুমের ওষুধ আনা উচিত ছিল৷ গোয়েন্দা গল্পে কখনো কাজে নেমে গোয়েন্দা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় না৷ গোয়েন্দাগল্প লেখকদের তো আর নিজেদের গোয়েন্দাগিরি করতে হয় নি!
কি দরকার ছিল কাজটা নেবার? টাকার দরকার ছিল ঠিকই, একটা বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে ঢোকার জন্য৷ কিন্তু সেজন্য দরকার পঞ্চাশ হাজার৷ তুচ্ছ দু’ হাজারের লোভে এই ঝামেলায় জড়ানোর মানে কি ছিল? খামোখা ঝোঁকের মাথায়! সোমেনের কাকাটাই যত নষ্টের গোড়া!
আচ্ছা যদি ভদ্রলোককে সব খুলে বলি, ক্ষমা চেয়ে নিই? কিংবা যদি কোনোভাবে ডায়েরীটা পেয়েই যাই? অতি দুঃখেও কেমন যেন হাসি পেয়ে গেল৷ মাথাটা একটু ঠাণ্ডা লাগল৷ আশা করতে ক্ষতি কি?
শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ কি সব যেন হিজিবিজি স্বপ্নও দেখলাম৷ ঘুম ভাঙল সাতটা নাগাদ, পাখীর ডাকে৷
দিনের আলোয় বাগানবাড়িটা ঘুরে দেখালেন ভদ্রলোক৷ খুব সুন্দর করে গোছানো বলা যায় না৷ বিলাসিতা আছে, কিন্তু সে যেন গতকালের উচ্ছিষ্টে কলংকিত সোনার থালার মত৷ বাড়িতে চাকরবাকর আছে জনাতিনেক৷ তাদের দুজন পুরোণো, একজন বোধহয় নতুন৷ কেমন যেন ধান্দাবাজ মতন দেখতে৷ একটা লাইব্রেরীও আছে৷ সেটাকে লাইব্রেরী না বলে, সংগ্রহশালা বলাই উচিত৷ বিদ্‌‌ঘুটে সব মূর্তিটুর্তি রাখা আছে৷ তাদের নাকি বাজারে অনেক দাম৷ পূর্বপুরুষদের সংগ্রহ৷
‘আমার কিছুমাত্র আগ্রহ নেই এসবে’, নিজে থেকেই জানালেন ভদ্রলোক৷ তবে বেচে দাও না কেন বাপু? কি লাভ এত টাকা ঘরের মধ্যে পাথর করে জমিয়ে রেখে?
একটা ঘোড়া দেখালেন৷ তার চোখদুটো নাকি দামী পাথরে তৈরী৷ কেমন যেন শ্যাওলা সবুজ রঙের৷ আহামরি কি এমন আছে কে জানে! বড়লোকের বড়লোকামি৷ কিছুমাত্র আগ্রহ দেখালাম না৷
কিন্তু সেই পাথরেই যে আমার ভাগ্য খুলবে কে জানত!
সংগ্রহশালাতেই ছিল সেই খেরোর খাতা, যাতে আছে সাংকেতিক লিপির মূল সংস্করণ৷ খানিকক্ষণ আতস কাঁচ দিয়ে সেই খটমট লিপির দিকে কটমট করে চেয়ে রইলাম৷ স্পষ্ট কিছুই বুঝলাম না৷ কিন্তু দিনের আলোয় গত রাতের মানসিক দৌর্বল্য কেটে গিয়েছিল৷ ফলে গোয়েন্দার অভিনয় করতে অসুবিধা হচ্ছিল না৷ লাঞ্ছনা যদি আসে তো আসবে, যে কদিন আরামে থাকা যায়৷ সেদিনটা গেল চিন্তা করতে৷ একটা ফিতে দিয়ে এদিক সেদিক কিছু মাপ নিলাম৷ ভদ্রলোকের বোধহয় আর কোনো কাজ নেই, সর্বদা আমার সঙ্গে ঘুরছেন৷ দুপুরে ঘন্টাখানেক বোধহয় দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন, তখনও একটা চাকর আমার উপর নজর রাখছিল৷ কেমন একটা মরিয়া ভাব এসে গিয়েছিল আমার মধ্যে৷ এরা আমাকে এত পাহারা দিচ্ছে কেন? আমি কি চোর নাকি? এদের কি এত চুরির ভয়? ডায়েরী?
পরদিন ঘটল ঘটনাটা৷ দুপুরবেলা আমরা আবার সেই সংগ্রহশালায় গিয়েছিলাম৷ এখানেই ডায়েরীখানা আছে কোনো একটা মূর্তির পেটের মধ্যে, এইরকম একটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম৷ সন্দেহটা ভদ্রলোকের মনে ধরেছিল৷ না ধরার কারণ নেই৷ ওই সব মান্ধাতার আমলের মূর্তিভরা ঘরে বিশ্বের যে কোনো রকম রহস্যই লুকিয়ে থাকতে পারে৷ মূর্তিগুলো তো আর ভেঙে দেখা যায় না৷ সুতরাং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো পথ নেই৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঠিক কি যে দেখছি জানি না, খালি গম্ভীর মুখে তদন্ত করে চলেছি৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই বুদ্ধিটা খেলে গেল মাথায়৷
সেই ঘোড়ার মূর্তিটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম ভদ্রলোকের৷ মোটামুটি বড় আকার৷ স্বচ্ছন্দে একটা ছোটো ডায়েরী ভরে ফেলা যায় এর পেটে৷ যদি কোনো ফাঁক থাকে৷ হাতে নিয়ে দেখা যায় কি? কাঁচের বাক্সের চাবী বেরোলো৷ পুরোণো আমলের শো-কেস, বেশ ভারী পাল্লা, চাবী ঢুকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসরত করতে হল৷ পাল্লাটা খুলল একদিকে বেঁকে৷ মূর্তিটা হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশ ভারী৷ পিছনে একটা ফুটো আছে বটে, কিন্তু আঙুল ঢোকাতেই বুঝলাম পথ একটু গিয়েই বন্ধ৷ কানের কাছে নিয়ে হালকা ঝাঁকুনি দিলাম৷ অতি মৃদু একটা রিনঝিন আওয়াজ শুনলাম যেন৷ কোথাও কিছু একটা ঢিলে আছে৷ কিন্তু নাঃ, ভিতরে ডায়েরী থাকলে সেটা ঢপর ঢপর করত৷ রেখে দিলাম মূর্তি শো-কেসে৷ ভদ্রলোক তালা দিতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি৷ যতই চাবী ঘোরান, তালা আর লাগে না৷ আটকে গিয়েছে কোনোভাবে৷ বিস্ময়কর নয়, যা পুরোণো জিনিস৷
পাশের শো-কেসেও একটা বেশ বড় মূর্তি ছিল, সেটাকেও একবার নেড়েচেড়ে দেখলাম৷ লাভ হল না কিছুই৷
দুপুরের খাওয়ার পরে ঘুমের একটা ঝোঁক আসে৷ ভদ্রলোকও ঘুমোতে যান বোধহয়৷ আমি তখন আমার ঘরটায় থাকি, আর বাইরে বুড়ো চাকরটা থাকে, কিন্তু সেদিন সেও নেই৷ একদল কারা যেন এসেছে, শুটিং পার্টি৷ পুরোণো জমিদার বাড়ির শুটিং করবে বলে এই বাড়িটা দেখে যাবে৷ বুড়ো বোধহয় তাদের তদ্বিরেই ব্যস্ত৷ এত বড় বাড়ি, কে যে কোথায় থাকে কে জানে! সুতরাং নিজের মত কাটানোর পক্ষে আদর্শ দুপুর৷
উঠে বসলাম একটা শোরগোল শুনে৷
ব্যাপার সাংঘাতিক! সেই ঘোড়ার মূর্তির একটা চোখ খোয়া গিয়েছে৷ বাড়িতে গোয়েন্দা থাকতে চুরি! গোয়েন্দার পক্ষে এত বড় অপমান আর কি হতে পারে! এক প্রস্থ লাঞ্ছনা তো কপালে নাচছিলই, তার সাথে আরেক প্রস্থ বুঝি বা এখনই যোগ হয়৷ নাকি উল্টে পাথর উদ্ধারের ভারও আমার উপরেই ন্যস্ত হবে? কিন্তু তার চেয়েও সাংঘাতিক একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মনে৷ আমাকেই শেষ্টা ধরবে না তো? হাজার হোক মূর্তির শো-কেসের দরজা যে খোলা ছিল সে তো একরকম আমারই জন্য৷ নিজের বাক্সটা তন্ন তন্ন করে দেখে রাখি, কোনো সন্দেহজনক কিছু না থাকে৷
ভদ্রলোক অনতিবিলম্বেই আমার ঘরে এলেন৷ ‘পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে তো?’ উৎকন্ঠিত শুধোই আমি৷ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পুলিসে খবর দেওয়া হয় নি—এই কথাটা শোনার একটা মৃদু আশা ছিল প্রাণে৷ কিন্তু না, পুলিসে খবর দিতে লোক গিয়েছে৷ যতক্ষণ পুলিস না আসে, কেউ যেন বাড়ির বাইরে না যায়৷
‘আর একটা কথা, আপনি যে এখানে ডায়েরীর ব্যাপারে এসেছেন তা যেন পুলিসকে বলবেন না৷ বলবেন আপনি আমার বন্ধু৷’
ও হরি, এ দেখি নিজেই ভয়ে মরে! এদিকে এত বড়লোক, ওদিকে পিছনে কি বাঁধিয়ে রেখেছে কে জানে!
পুলিস এল৷ সব শুনল টুনল৷ খানিক জিজ্ঞাসাবাদ করল৷ সন্দেহের প্রথম চোট শুটিং পার্টির উপর দিয়ে গেল৷ আমাকে আর ওই ছোকরা চাকরটাকে খানিক টানা হ্যাঁচড়া করার উপক্রম করেছিল৷ কিন্তু ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন৷ কিছু একটা গোলমাল যে আছে সেটা আঁচ করেছিলাম অনেকক্ষণ থেকেই৷ ডায়েরীর ব্যাপারটা ভদ্রলোক ভয়ানক গোপন রাখতে চাইছেন৷ পাছে আমাকে থানায় নিয়ে গেলে আমি বেফাঁস কিছু বলে ফেলি সেই ভয়ে নিতান্ত অপরিচিত আমাকে অনেকদিনের বন্ধু বানিয়ে দিলেন৷ আসলে বিশ্বাস যে কিছুমাত্র নেই তা তো টের পেয়েছি আমার উপর নজরদারি দেখেই৷
হাবেভাবে মনে হয় যেন ঘোড়ার চোখের পাথর চুরি যাওয়াতে বিরাট বিচলিত নন ভদ্রলোক৷ পুলিস ডাকাও যেন দায়সারা৷ ডায়েরী নিয়েই মাথা ব্যথা বেশী৷ কোনো মামলার কাজে লাগবে বলেছিলেন৷ হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য আছে তাতে৷ ডায়েরীটার যে হদিশ মিলছে না, সেটা প্রতিপক্ষকে হয়তো জানানো চলবে না৷ এ সবই অবশ্য আমার কল্পনা৷ সত্যমিথ্যা নিরূপণ করতে সত্যিকারের গোয়েন্দা লাগবে৷
পরবর্তী ঘটনা সামান্য৷ না, ডায়েরীর হদিশ করতে পারি নি৷ আরও দুদিন তদন্তের অভিনয় করে শেষমেষ ক্ষান্ত দিয়েছিলাম৷ ভদ্রলোক আমার কাজে যে বিরক্ত হয়েছেন সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি৷ তবে ওই চুরি যাওয়া পাথর নিয়ে যে আমাকে ঝামেলায় ফেলেন নি, এতেই আমি খুশী৷
ব্যর্থকাম হয়ে বিদায় নেবার একটা গ্লানি থাকতে পারত, কিন্তু আমি সেটা অনুভব করছিলাম না৷ খালি বিদায় নেবার আগে বাগানবাড়িটার চারধারে একবার ঘুরে আসতে গেলাম৷ এই শেষ পরিক্রমাটার খুবই দরকার ছিল৷ বড় কাঁঠালগাছের নীচে জমা পাতাগুলো পা দিয়ে একটু নাড়লাম৷ এই কাজটা কি ভুল করলাম? বিবেকের গ্লানি হয় নি তা নয়, কিন্তু অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে মানুষ কি না করে!
সেই আমার প্রথম ও শেষ গোয়েন্দাগিরি৷ শেষের তিন হাজার পাইনি বলে দুঃখ নেই৷ কিই বা হত তিন হাজারে? বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে ঢুকলাম মাস দুয়েক পরে৷ প্রথম একমাস পাথরটা বিক্রী করার সাহস পাই নি৷ বিস্তারিত বিবরণের আবশ্যক নেই৷ ঘোড়াটা প্রথমবার ঝাঁকিয়ে যখন বুঝলাম যে একটা চোখ আল্‌‌গা হয়ে আছে সেই সময় থেকে যেন মোহাচ্ছন্নের মত কাজ করে গিয়েছি৷ কিভাবে ধাঁ করে একটুকরো কাঠি চাবীর ফুটোয় ঢুকিয়ে শো-কেসের তালাটাকে অকেজো করার কথা মাথায় এসেছিল, তা আমি নিজেই ভেবে পাই না৷ তারপর সেই দুপুরের কথা৷ নির্জনতার সুযোগে শো-কেস থেকে ঘোড়াটা নিয়ে তার আল্‌‌গা চোখটা খুলে নেওয়া এবং বেরিয়েই কাঁঠালগাছের নীচে জমা পাতার মধ্যে ফেলে দেওয়া–আমাকে আরেকবার সেই কাজ দিলে আমি কিছুতেই পারব না৷ অগ্রপশ্চাৎবিবেচনাবুদ্ধি সম্পূর্ণ রহিত না হলে অতবড় ঝুঁকি কেউ নিতে পারে না৷ মোবাইলের নম্বর বদলালাম তার পরেই৷ পাথরটা বেচতে বেশ হাঙ্গাম হয়েছিল৷ কিন্তু সে বিবরণে যাব না৷ বছর কয়েক কেটে গিয়েছে বটে তারপর, তবু ধরা পড়ার ভয়টা পুরো যায়নি কিনা৷

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

পুরাতন খবর

SatSunMonTueWedThuFri
      1
23242526272829
30      
  12345
20212223242526
2728293031  
       
15161718192021
2930     
       
     12
24252627282930
       
2930     
       
    123
       
    123
25262728   
       
     12
31      
   1234
262728    
       
  12345
2728     
       
   1234
       
     12
31      
1234567
891011121314
15161718192021
2930     
       
    123
11121314151617
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
      1
2345678
23242526272829
3031     
      1
       
293031    
       
     12
10111213141516
       
  12345
       
2930     
       
    123
18192021222324
25262728293031
       
28293031   
       
      1
16171819202122
30      
   1234
       
14151617181920
282930    
       
     12
31      
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
       
© All rights reserved © MKProtidin.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com