হাফিজুর রহমান শিমুলঃ জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে খোলপেটুয়া নদীর অব্যহত ভাঙনে সাতক্ষীরা আশাশুনী সদরের মাত্র ১১টি পরিবার ৫৪ সদস্য নিয়ে মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হওয়ার প্রহর গুনছে দয়ারঘাট গ্রাম। আশাশুনী প্রেসক্লাবের সেক্রেটারী সমির মন্ডল জানান, ১৯৯৪ সাল থেকে খোলপেটুয়া গ্রাসে গিলে চলেছে গ্রামটির প্রায় ৪শ বিঘা জমি, ঘর-বাড়ি, পুকুর, বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ ও ফসলের ক্ষেত। প্রথম থেকেই নদী শাসন না করে পিছিয়ে রিংবাঁধ দিতে দিতে ৪শ বিঘা থেকে মাত্র ৯/১০ বিঘা জমি অবশিষ্ট আছে। বিগত ঘুর্ণঝড় আম্ফানে একই গ্রামে ফের ৩ পয়েন্ট ভেঙ্গে প্লাবিত হওয়ায় আবার নতুন ওয়াপদা রাস্তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এবার রাস্তা উঠলে এই ১১ থেকেই আবার ৪ টি পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। দুঃখীরাম, হরিপদ বিশ্বাস, কমলা বেওয়া ও নিমাই মন্ডল ভেঙ্গে যাওয়া ওয়াপদার স্লোপে বাস করেন। নতুন রাস্তা উঠলে এদের অন্যত্র যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ন্তর নেই। ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকেই নদী ভাঙ্গনে জমি দিতে দিতে তাদের কাঁচা-পাঁকা ঘরবাড়ি নদীতে বিসর্জন দিয়ে চলেছে। জন্মভিটা হারানো পরিবার গুলো হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামে, না হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। এখনও যারা পড়ে আছেন বাপ-দাদার ভিটা আঁকড়ে তারাও প্রতি বছর খোলপেটুয়া নদীর ভাঙ্গনে লোনা পানিতে হাবুডুবু খেয়ে চলেছেন। দয়ারঘাট গ্রামে এখনও টিকে থাকা পরিবার হলো মনিন্দ্র নাথ মন্ডল, দুঃখীরাম মন্ডল, হরিপদ বিশ্বাস, অজিত শীল, শ্বশ্মাণ শীল, নিমাই মন্ডল, মণ্টু মন্ডল, মদন মন্ডল, গণেশ মন্ডল, তারক মন্ডল ও পঞ্চরাম মন্ডল। বাঁধ হলে নতুন করে ওয়াপদার সোলপে চলে যাবেন মনিন্দ্র মন্ডল, শ্বশ্মাণ শীল, তারক মন্ডল ও মদন মন্ডল। বাঁধ স্থায়ী না হলে হারাধনের ছেলেদের মত দয়ারঘাট গ্রামে আর কেউ থাকবে না। গ্রামটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে। নদী ভাঙ্গনের ফলে দয়ারঘাট গ্রাম থেকে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হয়েছেন রুপচাঁদ মন্ডল ও দীপচাঁদ মন্ডল, গুরুপদ মন্ডল (জেলেখালী), প্রতিবন্ধী বিশ্বনাথ মন্ডল (ভারত), ভুচি বেওয়া, রনজিৎ সানা (ভারত), মনিন্দ্র সানা (আশাশুনি), কোমল সানা (পুঁটিমারী), সুকুমার সানা (আশাশুনি), বিমল সানা (বলাবাড়িয়া), ক্ষিতিষ সানা (আশাশুনি), বিধুরঞ্জন সানা (ভারত), বিশ্বনাথ সানা (আশাশুনি, সুদর্শন সানা (আশাশুনি)। এছাড়া জেলে পল্লীর ভ‚পতি মন্ডল সাতক্ষীরা গেলেও মধু মন্ডল, সন্ন্যাসী মন্ডল, বিমল মন্ডল, বিজয় মন্ডল, মতিলাল মন্ডল, হরি মন্ডল, সাধু মন্ডল, দুলাল মন্ডল, তারা মন্ডলসহ আরও অনেকে ভারতে চলে গেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মনিন্দ্র সানা, বিভূতি ভ‚ষণ রায়, রবিউল ইসলামসহ অনেকেই জানান- দয়ারঘাট থেকে জেলেখালী পর্যন্ত মাত্র ১১ চেইন রাস্তা সবসময়ই জরাজীর্ণ অবস্থায় থাকে। এছাড়া জেলেখালী থেকে মানিকখালী ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় দেড় কি.মি. ওয়াপদা রাস্তাও সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সরকার বরাদ্দ দেয় কিন্তু কাজ ঠিকমত হয়নি কোনদিন। ৬৫ বছরের পুরানো রাস্তা ভাঙ্গে, কর্তাব্যক্তিরা দেখে বরাদ্দ করেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবার যা তাই অবস্থা। কারও কোন জবাবদিহিতা নেই। সর্বশেষ আম্পানে ভাঙ্গনের আগে থেকেই একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ২০ লক্ষ টাকার বরাদ্দ নিয়ে কাজ করছিলেন। কাজ শেষ করার সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে নির্মাকাজ দ্রুত শেষ করা হয়নি। যেদিন ভাঙ্গে তার এক সপ্তাহ আগে সংস্কার কার্যক্রম চলা রাস্তার উপর প্রায় ২ হাজার বালু বোঝাই জিও ব্যাগ ভরা ছিল কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, উপজেলা প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধি কেউই সে গুলির ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখানকার ৩ টি পয়েন্ট ভেঙ্গে যায়। পিচের রাস্তার উপর দিয়ে রিংবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি আটকানো হলেও অদ্যবধি ৩ শতাধিক বিঘা জমিতে জোয়ার-ভাটা চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলে চলেছেন বরাদ্দ হয়েছে, অচিরেই কাজ শুরু হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন কাজ শুরু হয়নি। আশাশুনিসহ দক্ষিনের উপজেলাগুলির যাবতীয় উন্নয়ন নির্ভর করে নদীর শক্তপোক্ত বেড়িবাঁধের উপর রাস্তাঘাট, বনায়ন যাই করেন না কেন বেড়িবাঁধ যদি ভাঙ্গতে থাকে তবে সব উন্নয়নই ভেসে যাবে। উন্নয়ন অব্যহত রাখতে আশশুনি উপজেলাবাসীর ‘দাবী একটাই বাঁচতে হলে টেঁকসই বেড়িবাঁধ চাই’।