এ মাসের শেষ দশকের অন্যতম ইবাদাত হল ইতিকাফ। ইতিকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো :অবস্থান করা, আবদ্ধ করা,কোনো জিনিষকে বাধ্যতামূলকভাবে ধরে রাখা, নিজেকে শক্তভাবে আটকে রাখা। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহ. ইতিকাফ শব্দের বিশ্লেষণে বলেছেন, ইতিকাফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, শুধু অবস্থান করা। আর যে ব্যক্তি মসজিদে অবস্থান করেছে, তাকে আকিফ বা মু’তাফিক বলে। শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হলো, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদাতের জন্য পুরুষদের মসজিদে ও নারীদের গৃহে ইবাদাতের স্থানে অবস্থান করা।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ: বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর সাথে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা, যাতে তার চিন্তা ও ভালোবাসা মনে স্থান করে নিতে পারে।’
ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) তার হুজ্জাতুল বালিগা গ্রন্থে বলেন, ‘মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাকুলের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুল (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমল করেছেন।’
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইতিকাফ সম্পর্কে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন- “আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।” (সুরা : বাকারা : ১২৫)। এছাড়া
ইতিকাফ অবস্থায় আমাদের বিধি নিষেধ বা আচরণ কেমন হবে, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফকালে স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করো না।”(সুরা : বাকারা : ১৮৭)
পবিত্র কোরআনের পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসংখ্য হাদিসে ইতিকাফের গুরুত্ব, মহত্ত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে,যেমনঃ
ইতিকাফ কখন পালন করতে হয় এ প্রসঙ্গে
হযরত আয়েশা (রা.)হতে বর্ণিত হয়েছে,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং তা চলতে ছিল যতক্ষণ না আল্লাহ তার জান কবজ করলেন। (জামে তিরমিজি)
ইবনে উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম)। মদিনায় অবস্থানকালে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছরই ইতিকাফ পালন করেছেন। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও রমজানে তিনি ইতিকাফ ছাড়েননি। ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি (বায়হাকি)।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফে কাটান।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত ইতিকাফ করলেও কোনো কোনো সাহাবী নিয়মিত ইতিকাফ করেননি। এ প্রসঙ্গে ইমাম মালিক রহ. বলেছেন, হযরত আবু বকর রা. হযরত ওমর রা. হযরত ওসমান রা. ও ইবনুল মুসাইয়্যেব রা. নিয়মিতভাবে ইতিকাফ করেছেন বলে আমার নিকট খবর পৌঁছেনি। ইতিকাফের তীব্রতা ও কঠোরতার জন্য তারা কখনো কখনো ইতিকাফ করেননি। এ কারণে ঢালাওভাবে সবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। মহল্লার কেউ একজন পালন করলেই আদায় হয়ে যায়, কিন্তু কেউ পালন না করলে সবাই গুনাহগার হয়।
ইতিকাফে রাত্র এবং দিন অভিন্ন। ৯ দিন বা ১০ দিন (শাওয়াল মাস ২৯ বা ৩০ হওয়া পর্যন্ত) ইতিকাফকারীর উচিত মাহে রমজানের ২০ তারিখ মাগরিবের আগেই মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করা। অন্যথায় চন্দ্র মাসের হিসাবে ৯ দিন বা ১০ দিন পূর্ণ হবে না। আর ইতিকাফ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ হতে জানা যায় যে, পুরুষদের ইতিকাফ মসজিদেই হতে হবে। আর মহিলারা নিজ নিজ আসাবস্থলে নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে ইতিকাফ করবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ইতিকাফস্থল পরিত্যাগ করতে পারবে না। খাওয়া-দাওয়া মসজিদেই সম্পন্ন করতে হবে। পায়খানা-পেশাব কিংবা অজু গোসল ব্যতীত অন্য কাজের জন্য মসজিদের বাইরে গেলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
রমযান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসের সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ দিন হলো শেষ ১০ দিন। কেননা এ দশকেই রয়েছে পবিত্র শবে কদর। আরবি লাইলাতুল কদরের ফারসি হলো শবে কদর। বাংলায় ভাগ্যরজনী। এটি শ্রেষ্ঠতম রাত। এ রাতের ইবাদতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় শবে কদরে ইবাদত করবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম,বুখারি, হাদিস : ২০১৪)। শবে কদরের রাত কবে,
বিশেষ কারণে দিনক্ষণ ঠিক করে দেওয়া হয়নি।হয়তবা এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইবাদতের প্রতি মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। শবে কদর সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তুমি কি জান, লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১-৩)। শবেকদর হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। অর্থাৎ এক হাজার মাস ইবাদত করলে যে সওয়াব হতে পারে, এই রাতের ইবাদতে তার চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। এ রাতের কারণেই পুরো রমজান তাৎপর্য ও ফজিলতপূর্ণ হয়েছে।আর পবিত্র কোরআনও অবতীর্ণ হয়েছে এই দশকের কদরের রাতে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি এক মুবারকময় রজনীতে। আমিতো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।’ (সুরা : দুখান, আয়াত : ৩-৪)
হাদিস শরিফে এসেছে : ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবেকদর তালাশ কর।’ (বুখারি, হাদিস : ২০১৭)
হাদিসে রাসুল সা. শবে কদর সম্পর্কে আরো বলেন-আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে।’ এরপর মানুষ তাঁর সঙ্গে ইতিকাফে শরিক হয়। (মুসলিম, হাদিস : ১৯৯৪)। তবে নির্দিষ্টভাবে ২৭ রমজানের রাতকে শবেকদর বলা হয় এবং আমরা ইবাদত বন্দেগী মাত্র একদিনই করে থাকি যেটি উচিত নয়। কেননা হাদিস শরিফে শেষ দশকের বিজোড় রাতে শবেকদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। কোনো কোনো হাদিসে রমযানের শেষ সাত দিনের কথাও এসেছে। হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, কয়েকজন সাহাবি রমযানের শেষ সাত রাতে স্বপ্ন মারফত শবে কদর হতে দেখেছেন। সাহাবিদের এ স্বপ্নের কথা জানতে পেরে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি দেখছি তোমাদের স্বপ্নগুলো মিলে যাচ্ছে শেষ সাত রাতে। সুতরাং কেউ চাইলে রমজানের শেষ সাত রাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করতে পার।’ (বুখারি ও মুসলিম)
যারা এ রাতের রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত, তারা সবচেয়ে হতভাগা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এমন একটি মাস পেয়েছ, যার মধ্যে এমন একটি রজনী রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এই পুণ্যময় রাতে বঞ্চিত থাকে, সে সমূহ কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত থাকে। সে খুবই হতভাগা, যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে। (মিশকাত, ইবনে মাজাহ)
মূল কথা হলো, শেষ দশকের সব রাতেই যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদত করা চাই। বিশেষত শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে রমজানের অন্যান্য রাতের তুলনায় বেশি বেশি ইবাদত, নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল ও কোরআন তেলাওয়াত করা চাই। শবে কদরের একটি বিশেষ আমল হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমি শবে কদর পেয়ে যাই, তবে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘এই দোয়া পড়বে—আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।” অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী এবং আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।
তাই রমযানের বিগত দিনগুলো আমাদের যাদের অবহেলায় কেটে গেছে, এখনো সময় আছে নিজেকে শুধরে নেওয়ার। মুক্তির অবারিত সুযোগ পেয়েও আমরা যারা নিজেদের মুক্ত করে নিতে পারলাম না, তাহলে আমাদের চেয়ে হতভাগা আর কে?