আল্লাহ তা‘আলা এ পৃথিবীতে আমাদের সৃষ্টি
করেছেন এজন্য যে,আমরা একমাত্র তাঁর ইবাদাত করব। যে ইবাদাত হতে হবে অংশীদারমুক্ত, ত্রুটিমুক্ত ও নির্ভেজাল;কিন্তু ইবাদাতের ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের জানা-অজানা বা ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়। যেমনঃ একজন রোজাদার ব্যক্তি দিনের বেলায় পানাহার করেনি, স্ত্রী ব্যবহার করেনি, যার কারণে তার রোজা নষ্ট হয়নি বা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু পরনিন্দা করেছে, অশ্লীল কথাবার্তা বলেছে, অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলেছে, এতে রোজার ত্রুটি হয়েছে ; এ সকল ত্রুটিপূর্ণ কাজ আমরা অহরহ করতে থাকি যা সিয়াম পালনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইসলামী শরীয়তে এ সকল ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার জন্য আমাদের এমন কিছু দানের মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখিয়েছে যাকে “সাদাকাতুল ফিতর” বা “যাকাতুল ফিতর” বলে জানি। নবী করিম (সা.) সাদাকাতুল ফিতর এ জন্য নির্ধারণ করেছেন, যাতে ভুলক্রমে সৃষ্ট গুনাহ থেকে রোজা পবিত্র হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, “সাদাকাতুল ফিতর” দ্বারা রোজা পালনের সকল দোষত্রুটি দূরীভূত হয়, গরিবের পানাহারের ব্যবস্থা হয়।’ (আবু দাউদ)
এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজাকে অপ্রয়োজনীয় ও অশ্লীল কথাবার্তা ও কার্যকালাপ থেকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য এবং মিসকীনদের কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য যাকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন।(আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও বায়হাকী)
ওয়াকি ইবনুল জাররাহ (রা) (হাফেজে হাদীস, ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ এবং ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন)
বলেন, সিজদায়ে সাহু যেমন নামাজের ক্ষতিপূরণ, তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজার ক্ষতিপূরণ।
“সাদাকাতুল ফিতর” একটি যৌগিক শব্দ। আরবী অভিধান সমুহে শব্দ দুটির আলাদা অর্থ আছে । “সাদাকা” অর্থ দান। আর “ফিতর” অর্থ ভাঙা,রোজা রাখার পর ভাঙা, বন্ধ করা, বিরতি দেয়া। একত্রে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর রোজার বিরতি দেয়া বা রোজা ভাঙার কারণে সন্তুষ্টিচিত্তে প্রদান করা দান।
প্রয়োগিক অর্থে “সাদাকাতুল ফিতর” হল রোজার ত্রুটি- বিচ্যুতি থেকে মুক্ত থাকার জন্য ঈদের দিন সকালে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক (বর্তমান বাজার মূল্যে ৫৫০০০–৬০০০০ টাকা) কর্তৃক সমাজে অসহায় ও দুঃস্থ ব্যক্তিদের জন্য দান করা নির্ধারিত খাদ্য দ্রব্য বা টাকা। এখন কথা হল নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক “সাদাকাতুল ফিতর” আদায়ের মাধ্যমে ত্রুটিমুক্ত হতে পারেন; কিন্তু যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় তারা কীভাবে ত্রুটিমুক্ত হবেন? সেক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে তারা একে অন্যের মাধ্যমে ফিতরা আদায় করে নিতে পারবেন অথবা আল্লাহ তায়ালা কাছে দোয়া ফরিয়াদের মাধ্যমে ত্রুটিগুলো থেকে মুক্ত হতে পারবেন। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের জন্য “ সাদাকাতুল ফিতর”আদায় করা আবশ্যক । কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হন তার জন্য “সাদাকাতুল ফিতর” আদায় করা সুন্নাত বা নফল। তার জন্য স আদায়করা বাধ্যতামূলক নয়। তবে আদায় করা উত্তম হিসাবে গণ্য করা হয় । কেননা এটির গুরুত্বের কথা বর্ণনা করে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সদকায়ে ফিতর আদায় করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার রোজা জমিন ও আসমানের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে’ (কানযুল উম্মাল)
সাদাকাতুল ফিতর কাদের উপর,কী পরিমাণ এবং কী দিয়ে আদায় করতে হবে পবিত্র হাদিস সমুহে এর উল্লেখ করা হয়েছে যেমনঃ
* আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক গোলাম-স্বাধীন; পুরুষ-মহিলা;ছোট-বড় সকল মুসলমানের ওপর এক সা (সাড়ে তিন কেজি) খেজুর বা এক সা যব যাকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন এবং সেটি লোকেরা ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম)
* হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর সময় আমরা সাদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (বুখারি)
* মুসলিম শরীফের বর্ণনায় উল্লেখ আছে একবার মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) তার খেলাফাত আমলে হজ্জ বা ওমরা হজ্জ করার জন্য মদিনায় এলেন। তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বারে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। যে বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে,সে বিষয়ে তিনি আলোচনায় বললেন, আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (দাম হিসাবে) এক সা (সাড়ে তিন কেজি) খেজুরের। অতঃপর মানুষ ( উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়ীগণ) এই মত গ্রহণ করলেন। (মুসলিম)
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন সে যেন মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা করে যে;জেনে রেখো! প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী; গোলাম-স্বাধীন;ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর সদকায়ে ফিতর অপরিহার্য। দুই মুদ (আধা সা) গম কিংবা এক সা অন্য খাদ্যবস্ত্ত।(জামে তিরমিযি)
* হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রমযানের শেষ দিকে বসরার মিম্বারের উপর খুতবা দানকালে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন এক সা খেজুর বা যব কিংবা আধা সা গম; গোলাম-স্বাধীন, নারী-পুরুষ ও ছোট-বড় প্রত্যেকের উপর।(আবু দাউদ)
* হযরত আলী রা. বলেন, সদকাতুল ফিতর (এর পরিমাণ) হল, এক সা খেজুর বা এক সা যব কিংবা আধা সা গম। (দারু কুতনী)
উল্লেখকৃত হাদিস ছাড়াও আরো অনেক হাদিসে এক সা বা আধা সা এর পরিমাণের কথা উল্লেখ আছে। তবে যব, কিসমিস, পনির ও খেজুরের ক্ষেত্রে এক সা এবং গমের ক্ষেত্রে দুই মুদের (আধা সা) উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে হাদিসে নগদ অর্থ দিয়ে “সাদাকাতুল ফিতর” আদায় করার কথা উল্লেখ না থাকায় নগদ অর্থ দিয়ে আদায় করা যাবে কিনা এ নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আযম আবু হানিফা ও তার অনুসারীদের মতে, নগদ অর্থ দিয়ে “সাদাকাতুল ফিতর” আদায় করা যাবে। কেননা সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো দরিদ্র মানুষকে ঈদের আনন্দে শরীক হওয়ার সুযোগ করে দেয়া। এছাড়া ওমর ইবনে আব্দিল আজীজ,সুফিয়ান সাওরী,হাসান বসরীসহ অনেকের মতে নগদ অর্থ দিয়ে আদায় করা যাবে।
পক্ষন্তরে ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ (রহ.)এর মতে নগদ অর্থ দিয়ে আদায় বৈধ হবে না । কেননা হাদীসে নগদ অর্থের কথা উল্লেখ নেই।
“সাদাকাতুল ফিতরের” ওপর নাম “যাকাতুল ফিতর” অর্থাৎ এটিও এক প্রকার যাকাত সুতরাং যাকে যাকাত দেয়া যায় তাকেও ফিতরা দেয়া যায়।
তবে পিতা, দাদা, মাতা, নানিও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলে, মেয়ে ও অধঃস্তন এবং যার ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমনঃস্ত্রী), তাঁদের ফিতরা প্রদান করা যায় না। ভাই তার অভাবগ্রস্থ ভাগ্নে-ভাগ্নিকে দিতে পারবে
সাদাকাতুল ফিতরের মাধ্যমে রোজার ত্রুটিমুক্ত হতে পারলেও মূলত সাদাকাতুল ফিতরের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঈদের খুশিতে গরিব,অসহায় ও দুঃস্থ শ্রেণির মানুষদের শামিল করে নেওয়া। এতে একদিকে যেমন রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হবে, অন্যদিকে গরিব-দুঃখী মুসলমান খাওয়া-পরার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে অন্য মুসলমানের সঙ্গে ঈদের জামাতে শরিক হতে পারবে। এতে ধনী-গরিবের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান কমে আসে এবং ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই আসুন আমরা সকলেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করি।
লেখকঃ আব্দুল মুমিন
শিক্ষক
নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও
পিএইচডি গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
mk