The Penal Code (Act XLV of 1860) এর ধারা ৩১০ ও ৩১১ পড়াতে প্রিয় ছাত্রদের ঠগ সম্পর্কে অনেক কৌতুহল দেখতে পেলাম। নিজেও ট্রেনিং এর সময় কিছুটা জেনে ছিলাম, তবে তা ছিলো অস্পষ্ট। বর্তমানে এ ধারা দুটোর প্রয়োগ না থাকায় কর্মজীবনে অনেক ভুলেই বসেছিলাম। তবে এবার ছাত্রদের কৌতুহল দেখে আমারও ইচ্ছা জাগলো ধারা দুটো বইতে আছে অথচ ব্যবহার নেই। কারা সেই মহারথী যাদের সৌজন্যে Lord Thomas Bebington Macaulay সাহেব’কে পেনাল কোডে এই বিশেষ ধারা দু’টো সংযোজন করতে হয়েছিলো। পেনাল কোডের ৩১০ ধারায় ঠগের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ” যেই ব্যক্তি, এই আইন প্রচলনের পর যে কোন সময় খুন করিয়া বা খুন সহ দস্যুতা অনু্ষ্ঠান বা শিশু অপহরনের উদ্দেশ্যে অপর এক বা একাধিক ব্যক্তির সহিত মেলামেশা করিয়া থাকিবে, সেই ব্যক্তি ঠগ”। ৩১১ ধারায় শাস্তি — যেই ব্যক্তি ঠগ, সে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর (Transportation) দন্ডে দন্ডিত হইবে, তদুপরি অর্থদণ্ডেও দন্ডনীয় হইবে। ** তবে “দ্বীপান্তর” শব্দটি Ordinance No XLI of 1985 বলে “যাবজ্জীবন কারাদন্ড (Imprisonment)” দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
ঠগ বলতে প্রচলিত অর্থে আমরা বুঝি যে ঠকায় বা ধোঁকাবাজ কিংবা প্রতারক। কিন্তু Wikipedia তে খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে এক ভয়ংকর খুনী দস্যু সম্প্রদায়ের কথা। যারা পথিকের টাকা পয়সা, কাপড়-চোপড়, খাবার দাবার, কম্বল এমনকি সামান্য খুঁচরা পয়সাও কেড়ে নেবার পর দস্যুতার শিকার সকলকে গলায় রুমাল বা কাপড় পেচিয়ে হত্যা করে চিরতরে লাশ গায়েব করে দিতো। কখনোই খোঁজ মিলতো না সেসব লাশের। শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষেই নয় পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নির্মম নিষ্টুর নিপুন খুনীর দল বিরল। ঠগীরা ১৩ থেকে ১৯ শতকে তদানিন্তন সারা বাংলা ও উত্তর ভারতে ভয়ংকর ত্রাস কায়েম করেছিলো। মানুষ হত্যার রেকর্ড পৃথিবীতে নজিরবিহীন। শুধু ১৮৩০ সালেই তারা ৩০,০০০ মানু্ষ হত্যা করেছিলো। একজন ঠগী প্রতি মাসে গড়ে ৮/১০ টি খুন করতো। বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলেই খুন করার অনুমতি মিলতো। তারপর থেকেই সেটাই হতো নেশার মতো এক ভয়ংকর পেশা। সুতরাং কেউ যদি ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত অপরাধ কর্মে লিপ্ত থাকে তবে সংখ্যাটি কত হতে পারে অনুমান করে নিন। তবে সর্বোচ্চ ৯৩১টি খুন করে গিনেস বুকে নাম উঠিয়েছেন দস্যু বেহরাম। ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত একজন ব্যক্তি কর্তৃক সর্বোচ্চ খুনের রেকর্ড।
প্রায় সাড়ে চার শতাব্দী ধরে বাংলাসহ ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হারিয়ে গেছে অগণিত পথিক। নিখোঁজের তালিকায় রয়েছে ব্যবসায়ী, বনিক, তীর্থযাত্রী, কিংবা নিরীহ পথিক, কোতোয়াল, তদন্ত করতে যাওয়া পুলিশ, পুলিশের গুপ্তচর,,তাদের খুঁজতে যাওয়া সৈন্যদল , এমনকি বৃটিশ সাহেব মেম’গণও রক্ষা পায় নি ঠগীদের কবল থেকে। কোথায়, কখন, কিভাবে তারা হারিয়ে বা গায়েব হয়ে যেত জানতে পারতো না কেউই। কি যাদু বলে এত মানু্ষ নিখোঁজ হয়ে যেত ১৮১২ সালের আগে কারোরই জানার সৌভাগ্য হয় নি। গিনেস বুকের হিসাব মতে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা ২০ লক্ষ।
ঠগীরা ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে দল বেঁধে ভ্রমণে বের হতো। তাদের গুপ্তচররা বিভিন্ন হাটবাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতো। তারপর ঠগীরা পথ চলতে চলতে পথিকের সাথে মিশে যেতো, কথাচ্ছলে বন্ধুত্ব স্থাপন করতো। রাস্তায় একসঙ্গে বিশ্রাম করতো, রান্না খাওয়া দাওয়া করতো, কখনো নাচ গানের আসরও বসাতো। এভাবে দিনের পর দিন এক সাথে চলার পর বিশ্বাস স্থাপন করার পর কোন বিশ্রামের রাতে সুযোগ বুঝে ঘটাতো চরম নিষ্টুর কাজ,,, শ্বাসরোধ করে হত্যা।
প্রতিটি হত্যায় অংশ নিতো তিনজনের দল। একজন এক টুকরা কাপড় দিয়ে গলায় ফাঁস লাগাতো, অারেকজন পা চেপে এবং অন্যজন দুই হাত বা মাথা চেপে রাখতো। কেউ কোন পালিয়েও রক্ষা পেতো না, কারণ আশে পাশেই ওত পেতে থাকতো তাদের লোকজন, তারা পলাতককে পাকড়াও করে এনে একই কায়দায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করতো। তারপর লাশের হাতপা ভেঙ্গে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হতো। তবে নদীপথে দস্যুতার ক্ষেত্রে মৃতদেহ পানিতে ফেলে দেয়া হতো মর্মে ফরিদপুরের একটা ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আসামীদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় (সে ঘটনা পরবর্তীতে লিখবো আশা করি)
১২৯০ সালে সুলতানি আমলে বাংলায় আগমন ঘটে ঠগীদের। ময়মনসিংহ, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর এবং মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বিশেষ করে নদীপথে ছিলো তাদের ছিলো অবাধ বিচরন। ১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি’র লিখা “ফিরোজ শাহের ইতিহাস” গ্রন্হে প্রথম ঠগীদের সম্পর্কে জানা যায়। সে গ্রন্থমতে ১২৯০ সালে সুলতানী শাসনামলে প্রায় হাজার খানেক ঠগী ধরা পড়ে। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে সুলতান তাদের কোন সাজা না দিয়ে দিল্লী অঞ্চলে আর কোন দিন ফিরবে না এই শর্তে নানারুপ উপহার দিয়ে নৌকায় করে ভাটির দেশ অর্থাৎ এই বাংলায় পাঠিয়ে দেন। তারা ছড়িয়ে পড়ে বাংলার পথঘাট, জলে-স্থলে.. দিল্লীর সুলতানের ভালবেসে দেয়া এমন উপহারে এই বাংলাকে ভূগতে হয় প্রায় সাড়ে চারশ বছর….!!!
*** গ্রেফতার হওয়া অনেক ঠগী জিজ্ঞাসাবাদ করে ঠগী সম্পর্কে বৃটিশ ফিলিপ মিডোজ টেলর এর লেখা “কনফেশন অফ থাগ- সৈয়দ আমির অালী” এবং শ্রিপান্থের লিখা “ঠগ” অসাধারন দুটি বই। বইগুলো পড়ার আপনিও হারিয়ে যাবেন রোমহর্ষক জগতে এবং রোমাঞ্চিত হবেন। অাগামীতে সেখান থেকে কিছু ঘটনা তুলে ধরবো।
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান।