১৭২৫ সাল, মাঝ রাত,, দূর্গম এলাকার কোন এক নদীর মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে মাঝারী সাইজের একটা নৌকা…..
রাতের খাবার সেরে খানিকটা বিশ্রাম নিচ্ছেন কিছু লোক, পেশায় সকলে ব্যবসায়ী। চাঁদের আলো পাড়ের গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে তাদের গায়ে এসে পড়ছে। যাত্রীদের একজন হলেন রহিম খাঁ। তার খেলনার ব্যবসা, হাটে বাজারে ভালোই বেচাকেনা হয়। এবার মেলায় ভালোই লাভ হয়েছে, এখন বাড়ি ফেরার পালা। একাই যাচ্ছিল বাড়ির দিকে, কিছুটা ভয় হচ্ছিল। ভাগ্য ভালো যে, রাস্তায় এক ব্যবসায়ী দলের সাথে দেখা হয়েছে। ওদের ব্যবহার খুব ভালো। এখন দলও ভারী হয়েছে, তাই ভয়ও দূর হয়েছে।
খোদার রহমতে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলে খাসি জবেহ দিবে ভেবে রাখল। ব্যবসায় এবার ভালোই লাভ হয়েছে, কোমরে গোঁজা পেটমোটা কাপড়ের থলিটা খুব শক্ত করে ধরে রাখলো।
“তামাকু লাও” বললেন, ব্যবসায়ী দলের সরদার।
এ লোকটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে তার। ব্যবহার খুব ভালো, সুঠাম দেহের অধিকারী। কিন্তু তার মনে হল সবাই কেমন যেন নীরব হয়ে গেলো “তামাকু লাও” শোনার পর….!!
মনে ভাঁজ পড়ল, নৌকায় উঠার পর থেকে যাত্রীদের হাবভাব কেমন জানি লাগছিল। কেন যেন যাত্রী যাত্রী মনে হচ্ছে না বাঁকি লোকদের। অবশ্য বশির ছাড়া বাঁকিদের সুঠাম দেহ দেখে যে কারো এমন মনে হতেই পারে।
হঠাৎ গলায় প্রচন্ড ব্যাথা লাগলো। শক্ত কিছু দিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে ধরা হয়েছে। খেয়াল করলো সুঠাম দেহের যাত্রীরা নীরবে মিটিমিটি হাঁসছে। তাদের দু’জন তার পা চেপে ধরে আছে, কেউ একজন তার মাথা পাটাতনে চেপে ধরেছে আর হাত নড়াতে গিয়ে বুঝলো ওদুটোও শক্ত করে ধরা আছে। মাথা ঘুরিয়ে তাদের দেখার ইচ্ছেটা পুরণ হলো না। একটু শ্বাস নেবার চেষ্টা করলো, হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করেও সুঠাম দেহীদের সাথে শক্তিতে পেরে উঠলো না। এক সময় নিস্তেজ হয়ে গেলো বশির। মারা যাওয়ার আগে অস্পষ্ট গোংড়ানি – “ঠগিইইইই”…..
অনেক দেরী হয়ে গেছে, ঠগী চিনতে বড্ড দেরী করে ফেলেছে বশির খাঁ……!!!!
ঠগীরা ছদ্মবেশে দল বেঁধে মানুষ শিকারে বের হতো। একেকটা দলে থাকতো কয়েক শ পর্যন্ত। পথে বেরিয়ে ওরা ভাগ হয়ে যায় ছোট ছোট দলে। একেক জন একেক বেশে। কেউ তীর্থযাত্রী, কেউ সাধারণ ব্যবসায়ী। হাটে, ঘাটে, মেলায় কিংবা তীর্থস্থানে ওরা লোকজনের উপর নজর রাখে, খোঁজখবর নেয়। যদি বোঝে কারও কাছে টাকা কিংবা মূল্যবান কিছু আছে, তাহলে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে। এরপর দুর্গম পথে দেখা দেয় বন্ধুবেশে……!!
এরা অভিনয়ে খুব পাকা। বঙ্গদেশের নদীপথে ঠগীদের কাজের ধরন ছিলো আলাদা। এদের কেউ নৌকার মাঝিগিরি করতো, বাঁকিরা হাটে বন্দরে শিকারের খোঁজে বের হতো। পছন্দসই টার্গেটের বন্ধু হতো। এরপর এক নৌকার সারথী, একসাথে খাওয়া দাওয়া,গান বাজনা। তারপর মাঝনদীতে সুযোগ বুঝে সরদারের নির্দেশ, “তামাকু লাও” পাওয়া মাত্র নতুন বন্ধুর গলায় কাপড়ের ফাঁস এঁটে ধরা। তার আগ পর্যন্ত সবাই এমন ভাবে অভিনয় করতো যেন কেউ কাউকে চিনে না। এরপর দ্রুত কাজ সেরে লাশের মেরুদন্ড হাতপা ভেঙ্গে ফেলে দিতো পানিতে। জলপথের এই ঠগীদের নাম পাঙ্গু। এদের বিচরন ছিলো ময়মনসিংহ, ঢাকা, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে। ফরিদপুরে গ্রেফতার হওয়া সুবন জমাদার নামের এক কুখ্যাত পাঙ্গু ঠগী ও তার সাঙ্গপাঙ্গ’ দের কাছে এমনই অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছিলো…… (চলবে)
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান।