ঠগীরা নিজেদের মধ্যে বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় কথা বলতো, তা ছিলো খুবই সংক্ষেপে। যার অর্থ দলের লোক ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারতো না। এমনকি একদলের সংকেত অন্য দল খুব একটা বুঝতো না। ওদের সাংকেতিক ভাষায় নাম “রামোসি”…
ঠগিরা ঘুরে বেড়াতো ছদ্মবেশে, দল বেঁধে, একেক দলে ঠগি থাকতো কয়েক শ পর্যন্ত। পথে বেরিয়ে ওরা ভাগ হয়ে যেত ছোট ছোট দলে, একেক দল একেক বেশে। কোনো দল তীর্থযাত্রী, তো কোন দল সাধারণ ব্যবসায়ী। হাটে, ঘাটে, মেলায় কিংবা তীর্থস্থানে ওরা লোকজনের উপর নজরদারি করে, ভেতরের খোঁজখবর নেয়। যদি টের পায় কারও কাছে টাকাপয়সা কিংবা মূল্যবান কিছু আছে, তাহলে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে এবং সুযোগ বুঝে তার সাথে ভাব জমায়, এদের নাম “সোঁথা”। আর সোঁথারা নিরাপদে কাজ করতে পারছে কিনা কিংবা তারা আবার কোতয়াল বা তাদের গোয়েন্দার নজরে পড়ে গেছে কিনা সেটা নজরদারি যারা তাদের নাম “তিলহাই”।
এরপর দুর্গম কোনো পথে ঠগির দলটা পথের সাথি হতো বন্ধুবেশে…. রাস্তায় কত বিপদ-আপদ, দল বড় হলে বড্ড সুবিধা। হতভাগা পথচারীরা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পেতো না বন্ধুবেশে তাদেরই সঙ্গ নিয়েছে ভয়ংকর খুনির দল। ধীরে ধীরে দুই দলের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। একসঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়া, গানবাজনা। তারপর হঠাৎ গলায় মরণফাঁস। নিরাপদ জায়গায় তাবু বা আস্তানা গাঁড়ার দায়িত্ব পালন করে, “নিসার” রা।
সোঁথারা যখন পথিকের মন ভোলাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই “ভিল” বা “বিয়াল”রা ব্যস্ত থাকে ভালো জায়গা খুঁজে কবর রেডি করে রাখতে। দুই দলের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য থাকতো “তিলহাই” নামের কয়েকজন গুপ্তচর। একদল চলে যেত আশপাশের ইংরেজ কাছারিতে, ভালো মানুষ সেজে খবর নিয়ে আসতো পুলিশ বা সৈনিকদের। পরিস্থিতি খারাপ বুঝলে মূল দলের কাছে খবর পাঠিয়ে দিতো, অমনি সে এলাকা ঠগীদল থেকে হাওয়া।
ওদের অস্ত্র এক টুকরা কাপড়, অনুমান ৩০ ইঞ্চি লম্বা, যার একপাশে একটি বা দুটি তামার পয়সা বাঁধা। সময় সুযোগ বুঝে দলপতির নির্দেশ, “ঝিরনী” অর্থাৎ খুনের জন্য প্রস্তুত হও। “বাসন মেজে আন” মানে কবর খুঁড়ে রাখো। আর তাম্বাকু লাও বা তামাক লাও কিংবা পান লাও শোনা মাত্র শিকারের গলা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারা কাপড়ের ফাঁস। নিমেশে গলায় পেঁচিয়ে যাওয়া কাপড়ে হ্যাঁচকা টানে শুইয়ে ফেলা হয় শিকারকে। গলায় ফাঁস পরাতো “ভূকোত”, শিকারকে মাটিতে ফেলে দিতো “চুমিয়া” আর শিকারের হাত পা ধরে নড়াচড়া বন্ধ করতো “চামোসি বা “চুমাসিয়া”…
তারপর, “কুথাওয়া”রা মৃতদেহের মেরুদন্ড ও হাঁটুর জয়েন্ট ভেঙে লাশটাকে ভাঁজ করে ছোট করতো যাতে একগর্তে অনেকগুলো লাশ পুতে রাখা যায়। লাশের পাহারায় থাকতো “ফুরকদেনা”, এরা আবার কোন বিপদের সম্ভাবনা দেখলে বাঁকিদের জানিয়ে দিতো। অকূলস্থল থেকে কবর পর্যন্ত লাশ টেনে যেতো “ভোজা”রা। দ্রুত সেগুলো গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিতো, “লুগারী”রা। সে সময় হত্যাকান্ডের স্থানটি দ্রুত সাফসুতরো করে ফেলতো “ফুরজানা” রা…
এরপর কবরের ওপর তাঁবু গাঁড়ে ওরা, চলে খাওয়া দাওয়া, বসতো বিশেষ অমৃতের ভোজ। সে অমৃত আর কিছুই নয়, এক বিশেষ মন্ত্রপুতঃ গুড়। এমনকি তারা রাত্রিযাপনও করতো সে তাঁবুতে! যাতে কারও বোঝার উপায় ছিলোনা কি ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে সেখানে ..
পথচারীদের খুন করে তার সব সম্পদ লুটে নিতো ঠগীরা । সব সময় যে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যেত তা কিন্তু নয় । কোন কোন দিন হয়তো ভাগে মাত্র কয়েক পয়সা পাওয়া যেত। তবুও খুনে কোনো আফসোস ছিলো না। ঠগিরা অন্যদের ঠকায় কিন্তু দলের লোকদের কখনো এক আনাও ফাঁকি দিতো না। যখন যা পাওয়া যেত, দলের সকলের মধ্যে তা সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হতো । যেমন যে বাজারে কোতয়ালের খোঁজ নিতে গেছে, তার যতটুকু ভাগ, আবার ঘটনাস্থলে থেকে যে খুন করেছে, তার ভাগও ততটুকু। এক্কেবারে জেনুইন সাম্যবাদ..!!
আর দলপতিরাও ছিলো বিশাল কলিজার, তার দায়িত্ব অনেক,, পথে নামার আগে দলের সকল সদস্যের বউবাচ্চার জন্য কাপড়চোপড়সহ দু’মাসের অগ্রিম খোরাকী পৌছে যেতো, আর দলের কেউ অসুস্থ্য হলে বা মারা গেলে পুরো পরিবারের অাজীবন খরচ বহন করতো। পেশায় খুনী-ডাকাত হলেও ওরা মানুষ ভালো !!!
(চলবে)
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান।