আমার সকল ভালোবাসা পরীমনির জন্য। কারণ আমার মনে হচ্ছে এই পরিমনি গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। তাকে বলির পাঠা বানিয়ে অন্য কেউ ফায়দা লুটার চেষ্টা করছেন। মানুষ খাল কেটে কুমীর আনে। আমি এই স্ট্যাটাস লিখছি। পরীমনিকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে দিতে যারা বের হয়ে গেছেন, তারা যেন একটু বৈচিত্রের মাঝে বিনোদনের জন্য আমাকেও গালি দিতে পারেন।
আসেন, পরীমনি কে _ তাকে একটু চিনি।
পরীমনির আসল নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। ছোট বেলায় তার মা আগুনে পুড়ে মারা যায়। আগুনে পোড়ার সাথে সাথে সে মারা যায়নি । দীর্ঘ দুই মাস ভুগে- তারপর তিনি মারা গেছেন।
এরপর মারা যান পরীমনির বাবা। তাঁর মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। ব্যবসায়িক কারণে তিনি প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন।
অতএব বাংলা সিনেমার মতো পরীমনি খুব শৈশবে এতিম হয়ে যায়।
পরীমনি পালিত হয় নানার সংসারে। মজার ব্যাপার কি জানেন?
বরিশালের একটি স্কুল থেকে সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। এর আগে কেউ এই স্কুল থেকে বৃত্তি পায় নি। শুধু তাই নয়, এখন পর্যন্ত ওই স্কুল থেকে আর একজন শিক্ষার্থীও বৃত্তি পায়নি।
ঢাকার একটি পত্রিকার সাংবাদিকরা একটি ভালো কাজ করেছেন। তারা পরীমনির স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছেন। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, তারা পরীমনিকে এখনো স্নেহ করেন। শৈশবে পরীমনি ছিলো নম্র, ভদ্র এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এক অসাধারণ মেধাবী মেয়ে।
এরপর যা হয়। ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পরেই পরীমনিকে বিয়ে দেয়া হয়-ওই গ্রামের একজনের সাথে।
যদিও সেই সংসার দুই বছরের বেশি টেকেনি। না, যা ভাবছেন , তা নয়। সংসার পরীমনির কারণে ভাঙ্গেনি। স্বামী যৌতুকের জন্য দুই লাখ টাকা চেয়েছিলেন পরীমনির নানার কাছে। সে টাকা না দেয়ায়, সেই স্বামী পরিমনীকে তালাক দেন।
এই পর্যন্ত লেখাটি পড়ে একটু ভাবেন।
একটি মেয়ের জীবনে এর চাইতে ভয়াবহ, ধারাবাহিক দূর্ঘটনায় পূর্ণ, অভিশপ্ত জীবন আর কী হতে পারে?
তখনো কিন্তু পরীমনির নাম স্মৃতি। যেহেতু স্মৃতির রূপ ছিলো, একই সাথে ছিলো এক সাগর দুঃখ। একজন রূপবতী দুখী মেয়ে, শিকারের জন্য এর চেয়ে ভালো হরিণ আর কী হতে পারে? ঘটনার শেষ এখানেই হয়নি। তার অসহায়ত্ত্বের সুযোগ নিয়ে স্মৃতিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল বিয়ে করেন যশোরের কেশবপুর পৌরসভার সাবেক মহিলা কাউন্সিলর সাহানা কবির ফাতেমার ছেলে ফেরদৌস কবির সৌরভ। এই সৌরভের সাথেই সে চলে যায় রাজধানী ঢাকায়। ভালই চলছিল তাদের সংসারজীবন। হঠাৎ তাদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। স্বামী সৌরভ তাকে ঢাকায় রেখেই চলে আসে যশোরের কেশবপুর নিজ বাড়িতে। কিছু দিন তার সাথে যোগাযোগ রাখলেও ২০১৬ সালের পর তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ফুটবলার স্বামী সৌরভ। এক পর্যায়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি তার মেধা এবং রূপের বদৌলতে সুযোগ পেয়ে যায় ঢাকার চলচ্চিত্র অঙ্গনে। তার রূপ এবং মেধা খাটিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সকলের মনে স্থান করে নেয় সে। কাজেই স্মৃতি ক্রমান্বয়ে পরীমনিতে পরিণত হয়।
একবারও জিজ্ঞাসা করেছেন, কারা স্মৃতিকে পরীমনি বানালো?
পরীমনির নানার নাম, বাপের নাম পত্রিকাওয়ালারা ছবিসহ ছাপাচ্ছে। কিন্তু পরীমনির গডফাদারদের ক্ষেত্রে কেন পত্রিকাওয়ালারা লিখছে, ” জনৈক ব্যবসায়ী, জনৈক ব্যাংকার, জনৈক রাজনীতিবিদ, জনৈক আমলা, জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা?
এই সমাজের জনৈকরা একজন স্মৃতিকে একটা ভালো সিনেমা দিতে পারতো। একটা ভালো গল্প দিতে পারতো। ভালো লেখাপড়ার সুযোগ দিতে পারতো। তা না করে, স্মৃতিকে তারা পরীমনি বানিয়েছেন, দেশ বিদেশে ঘুরিয়েছে। তাকে নিয়ে লোফালুফি করেছে।
পরীমনির বাসায় যে মদের ভান্ডার , সেই মদ কি পরীমনি একাই খেতো? নাকি অন্য খদ্দের ছিলো? তারা কারা? পরীমনি কাদের জন্য এত মদ জমিয়েছিলো?
গালি না দিয়ে প্রশ্ন করতে শিখুন। গত কয়েকদিনে যেভাবে পশুর মতো আপনারা পরীমনিকে গালিগালাজ করছেন, কেউ কেউ পাথর ছুড়ে তাকে হত্যা করার দাবি জানাচ্ছেন, বিশ্বাস করুন, এটি একটি অসুখ। করোনার চেয়ে হাজার গুণ বড় ভাইরাস, যার নাম ঘৃণা।
আজকে শাহেদকে ঘৃণা করবেন, কাল হেলেনাকে ঘৃণা করবেন, পরশু পাপিয়াকে ঘৃণা তরশু করবেন পরীমনিকে।
ঘৃনা করতে করতে আপনারা ভুলে যাবেন, দেশে ডেঙ্গু বাড়ছে। ডেঙ্গুতে শিশুরা মারা যাচ্ছে। অথচ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। খালি মশা মেরে ফেলতে হবে।
ঘৃণা করতে করতে আপনারা ভুলে গেছেন, সিঙ্গাপুরের সবাই টিকা পেয়ে গেছেন, কিন্তু নয়া সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো টিকা পায়নি।
ঘৃণা করতে করতে আপনারা ভুলে গেছেন, দেশে সাবমেরিন আছে, কিন্তু আইসিইউ নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক।
আপনি ফেসবুক খুলবেন। পরীমনিকে গালি দিবেন, চয়নিকা চৌধুরিকে মম বলে টিজ করবেন।
একটু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। শোবার ঘরে আপনার বাবা কাশছেন, তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এই কাশি, এই শ্বাসকষ্ট তার প্রাপ্য না। তার দরকার সুচিকিৎসা, টিকা এবং অক্সিজেন।
বাবার পাশে গিয়ে বসুন। পরীমনি বা হেলেনা জাহাঙ্গীরে তার কিছু আসে যায় না। একশ পরীমনিকে ফাঁসি দিলেও তার কোনো আরাম হবে না।
তার দরকার একটি সংবেদনশীল সমাজ।
সেই সমাজ গড়ার দায়িত্ব আপনার। তা হলে আপনি এবং পুরো দেশ ভালো থাকবে।
@ জেমস আব্দুর রহিম রানা,
সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী।
স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক নাগরিক ভাবনা ও
সদস্য – বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম ( বিএমএসএফ)। মোবাইল : 01300832868