বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৪ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম:
গণমাধ্যমের অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় সভা আয়োজনসহ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন জনাব বাহারুল আলম নতুন সিইসি নাসির উদ্দীনের পরিচয় কালিগঞ্জে আছিয়া লুতফর প্রিপারেটরি স্কুলে মা সমাবেশ অনুষ্ঠিত সলেমান মামুন ব্যারিস্টার সুমন দুই দিনের রিমান্ডে ডিএমপির ৩৮তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন শেখ মোঃ সাজ্জাত আলী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা আলেমরাই এক দিন এদেশে নেতৃত্ব দেবেন।।ধর্ম উপদেষ্টা কে এই নতুন ডিএমপি কমিশনার? দৌলতপুরে বসতবাড়িতে ডাকাতির সময় মা-ছেলেকে হত্যার দায়ে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ

তৃষ্ণা বসাকের কবিতার সাম্রাজ্যে- তৌফিক জহুর

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১, ১২.০০ পিএম
  • ২১০ বার পঠিত
শুভ জন্মদিন কবি তৃষ্ণা বসাক। উদ্যান লিটল ম্যাগাজিন পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।
তৃষ্ণা বসাকের কবিতার সাম্রাজ্যে
তৌফিক জহুর
লেখক জীবন একটা ভ্রমণ। যেদিন থেকে সাদা কাগজে অক্ষরের পর অক্ষরের ইমারত নির্মাণ করতে থাকেন সেদিন থেকেই শুরু হয় ভ্রমণ। সাহিত্য চর্চা একটা জীবন চায় একজন লেখকের কাছে। অর্থাৎ চর্চায় লেগে থাকতে হয়। একজন লেখক যখন বহুমাত্রিক, বহুবর্ণিল লেখার জন্ম দেন তখন তাঁর গন্তব্য নির্ধারণ করা মুশকিল। শুধু তাঁর সৃষ্টির মাঝে আকন্ঠ ডুবে রস আস্বাদনই তখন মুখ্য বিষয়। আমরা তৃষ্ণা বসাকের লেখক জার্ণি নিয়ে যদি বয়ান করতে চাই তাহলে আমাদের একটা সময়কে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। কবে, কিভাবে একজন লেখকের কলমের নিবে প্রথম অক্ষর উঁকি দিয়েছিল তা সেই লেখক বলতে পারবেন। তবে তৃষ্ণা বসাক যেহেতু নব্বই দশকের কবি তাই আমরা বলতেই পারি তিন দশক পূর্বে এই লেখক আঁতুড়ঘর থেকে এসেছেন। কোলকাতার “দেশ” পত্রিকায় ১৯৯২ সালে “সামগন্ধ রক্তের ভিতর” কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। জন্মেই সুতীব্র চিৎকারে একটি শিশু পৃথিবীতে তার উপস্থিতি জানান দেয়। কবিতায় তাঁর এই উপস্থিতি সমসাময়িক কবিদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে। প্রশ্ন উঠতে পারে কিভাবে আলোড়িত করে? উত্তর হচ্ছে, ভাষায়, শব্দের বহুমাত্রিক নিরীক্ষায়, উপমায়, উৎপ্রেক্ষায় ও চিত্রকল্পে। প্রত্যেক কবির থাকে সহজাত আত্মতাড়না। এই আত্মতাড়না থেকে সৃষ্টি হয় জীবনমুখী কবিতার বহুবর্র্ণিল মিশেল স্রোত। তৃষ্ণা বসাকের কবিতার ঠাসবুনন, শব্দের আদর, আমাদের এমন এক অর্থের দিকে নিয়ে যায় যা অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়। তৃষ্ণা বসাকের কবিতার অন্তর্গত, নিগূঢ় অর্থ কল্পনার সীমানা অতিক্রম করে সুউচ্চ মসনদে আসন গ্রহণ করে। জগত সংসারের যাপিত জীবন, কল্পনার চোখ, পৃথিবী, আসমান, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, পর্বত, ফুল, নারীসত্ত্বা সবকিছুকেই কবি ধারণ করছেন চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র জগত নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ঝলসানো শব্দ নয় পরিমিত বোধ ও শব্দের আদর খেলা করে তৃষ্ণা বসাকের কবিতায়। তাঁর শব্দ চয়নের রুচিবোধ ও সৃষ্টি শক্তির সহজাত দক্ষতায় আমরা মুগ্ধ হই। তৃষ্ণা বসাক একজন কবি, একজন কথাশিল্পী। অসংখ্য শব্দ হুড়মুড় করে তাঁর ঘরে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু সব শব্দকেই একজন কবি হয়ে, একজন কথাশিল্পী হয়ে তিনি প্রশ্রয় দেন না। প্রথমেই বলেছিলাম তাঁর লড়াকু মন বিপ্লবী কিন্তু শব্দ প্রয়োগে অত্যন্ত রুচিশীল। তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী অনুবাদকর্মে প্রতিমুহূর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “অজিত সিং বনাম অজিত সিং” বর্তমানে আলোচিত সৃষ্টি। সেই উপন্যাসের বিজ্ঞাপনের ভাষা একটু লিখছি, “বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস “অজিত সিং বনাম অজিত সিং”-এ। সব কথনই রাজনৈতিক সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক। ঝাঁকুনি লাগতে পারে।” বিজ্ঞাপনের শেষ লাইনটা লক্ষ্য করুন। সিটবেল্ট বেঁধে পড়তে বলেছেন। নইলে ঝাঁকুনি লাগতে পারে। এখানেই তৃষ্ণা বসাকের কারিশমা ভাষার ঠাসবুননে এতোটাই মোহবিস্ট করবে সিটবেল্ট না বাঁধলে পাঠ করতে যেয়ে ঝাঁকুনি লাগবে। আজকে আমরা মূলত বয়ান করবো তৃষ্ণা বসাকের কবিতার নির্মাণ কারুকাজ নিয়ে।
যুগের জ্বালা-যন্ত্রণা ও নৈরাশ্য থেকে শুরু করে শুভবোধ ও রেণেসাঁসের মানবতাবোধের আশাবাদ তাঁর কবিতার পথকে মসৃণ করেছে। দিক্ নির্ণয়ের জন্য জীবনাদর্শের ধ্রুবতারার সন্ধান পাই তাঁর কবিতায়। কবিতার ইতিহাস বাঁক বদলের ইতিহাস। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার, সবচেয়ে সমৃদ্ধ দশক হিসেবে নব্বই দশকের সময় উল্লেখ করলে অত্যুক্তি করা হবে না। এই সময়ে উত্থান তৃষ্ণা বসাক। স্বভাবতই তাঁর কবিতার মাঝে তত্ত্বের ভান্ডারের চেয়ে সমসাময়িক বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ নিয়ে তিনি কাব্যের সীমানা বাড়িয়েছেন। বিবর্তনের পথে তাঁর কবিতা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করে চলেছে। ইন্দ্রিয়ঘন, পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর কবিতা চমৎকার উত্তাপ সৃষ্টি করে। আর সে কারণেই সৌন্দর্যের উপলব্ধি, প্রেমের বিশ্বব্যাপী চেতনা, মনুষত্ববোধ ও পরিপূর্ণতার আদর্শ আমরা খুঁজে পাই তাঁর কবিতার সাম্রাজ্যে। যেহেতু কবিমাত্রই মননশীল, কবিমাত্রই বিদ্রোহী। তাই আমরা তাঁর কবিতার মাঝে পরিবর্তনের রূপ খুঁজে পাই। কবির মনোভঙি যুগের পরিবর্তিত মানসিক ও সামাজিক পরিস্থিতির প্রভাবে ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে উঠেছে, কবিতায় তার স্বাক্ষর আমরা খুঁজে পাই। প্রত্যেক কবিকে তা তিনি প্রাচীন অথবা আধুনিক যাই হোন না কেন তাঁকে তাঁর ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করতে হয় তখন তিনি ক্লাসিকধর্মী, আবার শুধুমাত্র ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে কাব্যরচিত হয়না, কবিকে নতুন উদ্ভাবনও করতে হয়, তখন তিনি রোমান্টিক। ঐতিহ্যকে কবি নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহার করেন, এর মধ্যে আমরা কবির রোমান্টিক মনের পরিচয় পাই। সেজন্য কবিমাত্রই একাধারে ক্লাসিক ও রোমান্টিক। আমরা যখন পথ চলি তখন একটি পা সামনের দিকে আর একটি পা পিছনে। সামনের পা-টি এগিয়ে নিয়ে যায় আর পিছনেরটি ভারসম্য বজায় রাখে। তেমনি কবি যেমন নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করেন, তেমনি আবার পুরনো ঐতিহ্যের আশ্রয়ও নেন, ভারসাম্য রক্ষার জন্য। এতোক্ষণ তৃষ্ণা বসাকের কবিতা নিয়ে যে বয়ান করে চলেছি তার স্বপক্ষে কয়েকটি কবিতার উদাহরণ দেয়া যাক। তাহলে কুয়াশা ভোর কেটে সোনালি সূর্যালো পরিষ্কার অনুভব করা যাবে। তৃষ্ণা বসাক ও তৌফিক জহুরের যৌথকাব্যগ্রন্থ “ঠান্ডা মাংস এবং আগুনের চুল্লি” থেকে কয়েকটি কবিতা উদ্ধৃত করছি।
১। “ কিন্তু যে কোনো কাজ শুরু করার আগে
আমাকে বারবার, রিওয়াইন্ড করে দেখে নিতে হয় বাবার মৃত্যু,
টেবিল থেকে টেবিলে ফাইলের কফিনে চড়ে
চালান হয়ে যায় ১৮টি শিশুর মৃতদেহ
ধূলো, পুরো ধূলোয় দু-চোখ আবৃত করে আমি বসে পড়ি,
মহার্ঘ বসনের মায়া না করে আমি বসে পড়ি রক্তকীর্ণ প্রান্তরে
সৌরবলয়ের মধ্যে আমি এক দগ্ধ ডানা মানুষ
হে মৃত্যু, আমাকে ভুল করেও প্রণত ভেবোনা”
[ধূলি রাষ্ট্র ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-১২]
২। রক্তচাঁদের মতো সকাল
ধীরে ধীরে নদীর পাড় বেয়ে উঠে আসে
নদীতে পা ডুবিয়ে যে রমণীরা
তাদের গতরাতের
ব্যর্থতা, সাফল্যের গল্প বলেছিল
তারা ক্ষণিকের জন্য বাক্য হারা।
তাদের গলায় রক্তবীজের মালা, স্তনে নখরক্ষত,
একটি হারানো নূপুরের জন্য
তারা সারা পৃথিবী তোলপাড় করতে পারে!
কিন্তু এমন সকাল তারা কখনো দেখেনি
চেরিফুলের ফাঁক দিয়ে
রক্তচাঁদের মতো সকাল
রাঢ়ভূমিতে এই প্রথম।
[রক্তচাঁদের মতো সকালে ও রাঢ়ভূমির রমণীরা ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-১৫ ]
৩। তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবেনা
রাতের অন্ধকারে একে চিরে চলে যাবে, যেন কন্ডোমবিহীন জিপ,
আর এ পাড়ে থাকবে পারাপারহীন ফ্লাইওভারের মতো
তোমার অশ্বারোহীর মতো পুরুষাঙ্গের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবে না
কমলা লেবুর মতো স্তন দুটি, ঠান্ডা যেন সদ্য ফ্রিজ থেকে বার করা
রেশম বেড়ালের মতো যোনি, কাঠ, এখনি মাছি বসবে
রোদ ঠিকরানো নিতম্ব বেয়ে কয়েকটি পিঁপড়ে
নিজেদের মধ্যে ব্যস্তভাবে কথা বলতে বলতে উঠে যাচ্ছে
তুমি অনেক চড়াই উতরাই ভেঙে এসে ওর বুকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছো
ওর স্তনের সুপেয় তরল কখন শুকিয়ে গেছে, বুঝতে পারোনি
তোমার উন্মুখ শরীরের নিচে এ শহরকে আর আগের মতো পাবেনা।
[ঠান্ডা মাংস ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-১৭]
জীবন সম্বন্ধে বিশিষ্ট মনোভঙি আমাদের আকৃষ্ট করে। তৃষ্ণা বসাক নিজের বক্তব্য বিষয়ের উপযুক্ত ভাষা নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছেন। কাব্যের যেহেতু একটি নিজস্ব জগৎ আছে কবি সেই জগতে পুরোপুরি প্রবেশ করে নিজের কণ্ঠস্বর আমাদের শোনান। আমরা একটি কথা বলতে পারি, তৃষ্ণার কবিতার ভাষায় আবেগের তারল্য, উচ্ছাস, প্রবণতা ও অতিকথনের ভারে চোরাবালিতে নিমজ্জিত নয়। তাঁর কবিতা আমাদের যাপিত জীবনের অনেক কিছুই ইংগিত দেয়। একটি নিজস্ব জগৎ সৃষ্টির লক্ষ্যে কবি তাঁর কবিতায় চিত্র আঁকছেন। যে কবি যত বেশি স্বতন্ত্র ও অভিনব তিনি তত বেশি কবিতায় বিশাল ক্যানভাস আঁকতে সক্ষম হন। কবির চেতনাকে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আর যখন তা দাঁড়িয়ে যায় আমরা অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের সাগরে ডুবতে থাকি।
“ যদি আমার বেড়ালের নাম মজন্তালি হয়
কিংবা আমার কুকুর পুষতে ভালো লাগে
অথবা ধরুন আমার কোনো পোষ্যই নেই,
যদি আমার নাকটা ঠিক আপনার মতো না হয়,
যদি আমার স্তন থাকে কিংবা না থাকে আর আমি
একজোড়া সুডৌল স্তন নির্মাণের স্বপ্ন দেখি,
যদি আপনি এমন একটা ভাষায় কথা বলি যা আপনি জানেন না
কিংবা আমার কোনো ভাষাই না থাকে, তো?
যদি আমাদের পাড়ার সব বাড়ি রামধনু রঙের হয়,
যদি আমরা মাঝে মাঝে প্রথম পাতে তেতো না খেয়ে শেষ পাতে খাই
যদি আমার বোন কাঁথা না বুনে দিনরাত আঁক কষে,
আর আমার মা ছাদে উঠে হঠাৎ হঠাৎ ঝুলঝাড়– দিয়ে দু’চারটে তারা
পেড়ে আনে আমরা খেলব বলে,
যদি আমার কোনো বাপ-মা নাই থাকে
ল্যাবপ্রসূত আমাকে যদি একটা সঙ্কেত দেয়া হয়
আর যদি সেই নম্বরটা আপনার মামা শ্বশুরের পছন্দ না হয়
যদি
যদি
যদি
যদি
যদি
[যদি ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃ-২৩]
মানুষের সবচেয়ে বড়ো ক্ষমতা বুদ্ধি নয়, হৃদয় নয়- কল্পনা। কবিতা এতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এজন্যেই যে কল্পনা তার পিছনে সবচেয়ে প্রবলভাবে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে কাজ করে যায়। তৃষ্ণা বসাকের ‘যদি’ কবিতাটি যতোবার পাঠ করি এর অন্তর্গত ব্যাখ্যা হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। নব্বই দশকের কবিতায় এই প্রগতিমনষ্কতা যেখানে গোপনীয়তা, নীরবতা, একাকিত্বের আরাধনা। যেখানে ‘মা’ হচ্ছেন মিথ। আবার সমাজকে তির্যকভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া- কবির প্রগতি কোনো বাইরের শাস্ত্র আচার অনুষ্ঠান বা মতপন্থা নয়, কবির প্রগতি একমাত্র তাঁর নিজস্ব নিয়মে চলা, স্বরচিত শাস্ত্র মানা।
“রক্তচাঁদের মতো সকাল ও রাঢ়ভূমির রমনীরা” কবিতাটি সমাজের এমন একটি বিষয় ইংগিত দিয়ে যায় যা সমাজব্যবস্থার একটা অংশ। যা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো কবিতাটির নির্মাণ কাঠামোতো এর সৌন্দর্য নির্মাণ। শব্দের আদর মাখিয়ে তৃষ্ণা বসাক কবিতাটি সৃষ্টি করেছে। কবি যে একক একটি আলাদা সত্ত্বা, তাঁর দেখার ভঙি আলাদা, শব্দ চয়ন আলাদা তা এই কবিতায় দারুণ মুন্সিয়ানায় তৃষ্ণা বসাক অঙ্কন করেছেন। কবিতা লেখার জন্য নিজের গভীর বিবরে ঢুকে যাওয়া চাই। সেখানে সমাজ, রাষ্ট্র নেই আছে অপার অনন্ত আমি। সেখানকার সমুদ্রের নাম আমি, আর সমুদ্রের মাঝখানে যে একখানি সবুজে ছাওয়া দ্বীপ আছে, তার নামও আমি। সেই দ্বীপে যে জাহাজ, নৌকা, স্পিডবোড বাঁধা আছে তার নামও আমি। কবিতা এমন এক জিনিস যা আত্মার সর্বস্ব দখল করে। কবিতা আক্রান্ত একজন মানুষের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই বিস্বাদ মনে হয়। যদি সে সহীহভাবে কবিতায় আকন্ঠ ডুবে যায়। চিত্রকল্পের ঠাসবুননে নির্মাণ করেছেন “লাইব্রেরি, শার্টখোলো”-কবিতাটি। আমরা লক্ষ্য করি ঃ
“ লাইব্রেরি, শার্ট খোলো,
আমাকে আর বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখোনা।
জিপার একটানে ছিঁড়ে গলন্ত অক্ষর চেটে নেব,
তোমার গ্রিক ভাষ্কর্যের মতো শরীর,
গোপন অঙ্গ বিভঙ্গে বই আমি কামার্ত পাঠক-
তোমার প্রথম সোপানে আমি সমস্ত পাপভার নামিয়ে রাখলাম
যেন পচা মাংসের পসরা।
লাইব্রেরির সিঁড়িতে কেউ মাংস রাখে? আমি তো রেখেছি
এমন কি আমার দুই স্তন,
তাও দুটো কাচের পেপারওয়েটের মতো তোমার করতলে
তুমি দেখো, দেখে যাও
কাচের কাগজচাপার মধ্যে গোলাপি ডালপালা
সবুজ মরুভূমি আর পার্পল পৃথিবী !
আমি আরও উঠি,
চক্রাকার সিঁড়ি, তোমার উরু ঘিরে ঘিরে উঠেছে
সিঁড়ির প্রতিটা ধাপের নিচে নিচে বই-
একটু জায়গাও নষ্ট করা হয়নি,
আমি উঠতে উঠতে পড়ি
করতে করতে পড়ি
পড়তে পড়তে করি !
করি- এই ক্রিয়াপদ আমাকে পাঠক হিসেবে উত্থান দেয় …..
[লাইব্রেরী শার্ট খোলো ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু পৃষ্ঠা -২০]
কবিতা মানে রূপান্তর। কবিতা মানে বদল। কবিতা মানে পরিবর্তন। কবিতা মানে তির্যকতা। কবিতায় সব কিছুই প্রতীক। শব্দ, ছন্দ, চরণ, চিত্রকল্প, মিল-অনুপ্রাস, যতিচ্ছেদ, উপমা- উৎপ্রেক্ষা সব কিছুই প্রতীক। এই শব্দগুলো এখানে যুক্ত করলাম- “লাইব্রেরি, শার্ট খোলো” কবিতাটি পাঠ করে। ‘লাইব্রেরি’- এখানে কবি কি অর্থে ব্যবহার করেছেন। অতিন্দ্রীয় অনুভবে ধ্যানে কবি ‘লাইব্রেরি’ কে পবিত্র উপাসনালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেখানে পচা মাংস রাখা যায় না। “লাইব্রেরির সিঁড়িতে কেউ মাংস রাখে? আমি তো রেখেছি/এমনকি আমার দুই স্তন”- কবিতা সত্ত্বার গভীরতম তল থেকে উত্থিত হয়। সাহিত্যের আর কোনো মাধ্যম অতো গভীরে যেতে পারেনা। তাতে ধরা পড়ে এমন অনেক কিছু যা দৃশ্যজগতের অন্তর্গত; এমন অনেক কিছু যা অদৃশ্যজগতের অংশ। কবিতা একই সঙ্গে কাজ করে মনন ও কল্পনা ও অনুভূতি ও উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে। তৃষ্ণা বসাকের কবিতা দৃশ্যজগৎ ও অদৃশ্যজগৎ মিলেমিশে কবিতায় অন্য এক সত্যতর জগৎ জাগ্রত করেছে। কোলাহলময় পৃথিবীতে নির্জন, নিরব, জায়গা হচ্ছে লাইব্রেরি। লাইব্রেরির শেলফে-শেলফে যে অসংখ্য গ্রন্থ বসে থাকে তা শান্ত কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায় যে বাক্যবন্ধ রয়েছে তা হৃদয়ে উত্তাল ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করে। কবি অসংখ্য বইয়ের একজন বিদগ্ধ পাঠক। প্রাণের উদার বিস্মিত জাগরণ ঘটে লাইব্রেরির সংস্পর্শে গেলে। লাইব্রেরি মানেই শত-শত জ্ঞানের দরোজা। আর লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চা মানে, মাঠে প্রজাপতির মতো কিংবা নিজের ক্ষেতে চাষির মতো স্বাধীন ও আনন্দময়।
লাইব্রেরি নিয়ে তৃষ্ণা বসাকের আর একটি কবিতা আমরা লক্ষ্য করি ঃ
“ এ ভারি মজার লাইব্রেরি,
যেখানে আসার সময় ব্যাগে সুইমিং কস্টিউম নিয়ে আসতে হয়
আমি ভাসতে ভাসতে পড়ি
ডুবতে ডুবতে পড়ি
সাঁতারের চিৎ, উপুড়, প্রজাপতি, এমনকি প্রণয়-রুদ্ধ ভঙিমাও
আমার শেখা হয়ে যায়।
লাইব্রেরিতে তো লোক শেখার জন্যেই আসে, আমিও এসেছি
এতোটাই নতশীর যে প্রবেশের দরজাই প্রথমে খুঁজে পাচ্ছিলাম না,
তারপর দেখি, কোনো দরজাই নেই
এটা একটা ওপেন লাইব্রেরি
সবুজ সিরাপের মতো ছোটো ছোট বনবীথি দিয়ে ঘেরা
তাই অনেকেই প্রথমে ঢোকার রাস্তা খুঁজে পায়না
আমি পেয়েছি।
আমি অনেক দূরের এক গ্রহ থেকে হাঁটতে-হাঁটতে
এখানে এসেছি পাঠ করে তৃপ্ত হব বলে,
আমাকে নেবে না লাইব্রেরি?
[আমাকে নেবে না লাইব্রেরি ঃ ঠা.মা.এ.আ.চু, পৃষ্ঠা-২১]
শিল্পবোধ ও জীবন চেতনায় জ্ঞানের পথ যখন কবি, আবিষ্কার করে ফেলেন তখন দেখা যায় নির্মল রৌদ্রে একটা বিশাল সুনীল আকাশ তিনি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শুরুতেই বলেছিলাম নব্বই দশকের অধিকাংশ কবির কবিতায় কলাকৌশল সম্পূর্ণ আধুনিক কিন্তু বিষয় গরিমায় অনেকের কবিতায় প্রাচীনতাও আছে। শত-শত বছর আগের নির্মাণ ‘লাইব্রেরি’। সেই বিষয়কে নিয়ে তৃষ্ণা বসাক আবেগের জলধারাকে মানবসৃষ্ট লোকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করে সমুদ্রে মিশিয়েছেন। তাঁর শুভবোধের নির্মাণ কৌশলে আমরা ডুবে গিয়ে খুঁজে পাই ঝিনুক, মণি, মুক্তো। তাঁর কাব্যভাষা আলাদাভাবে নির্মিত। তাঁর কবিতার পথ নিজস্ব। কোনো-কোনো কবি থেমে যান। গতানুগতিক লেখাই লিখে যান চিরটাকাল। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সমানভাবে অগ্রসর হয়ে যেতে পারেন না। তার কারণ তাঁদের চিন্তা ও চৈতন্য থেমে পড়ে; তাঁদের শরীর সত্ত্বার চলিষ্ণু থেকেও মানস সত্ত্বার স্থির হয়ে পড়ে। তাঁরা আর হয়ে ওঠেন না। কিন্তু তৃষ্ণা বসাক অবাক ব্যতিক্রম ও সচল। তৃষ্ণার কবি মন সর্বত্রগামী। যেহেতু কবিতা সর্বত্র থাকে তাই এই কবিতা প্রকৃতিকে অনুসরণ করেনা; কবিতা জীবনকে অনুসরণ করে না; কবিতার একমাত্র কাজ ব্যক্তিমনের অনুসরণ-প্রতিসরণ, ব্যক্তিমনের ফলন-প্রতিফলন। এ কারণেই তৃষ্ণা বসাকের কবিতা পাঠে আনন্দ-যন্ত্রণা মিলে আমাদের পাঠক হৃদয়ে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় কবিতা পৃথিবী। আদ্রে র্যাবো বলেছেন “দ্রষ্টা হতে হবে, নিজেকে তৈরি করতে হবে দ্রষ্টা।” কবিতার একটা স্বতন্ত্র পথ নির্মাণ করে ইতোমধ্যে বিদগ্ধ পাঠককূলের নজর কেড়েছেন তৃষ্ণা বসাক। বাংলা কবিতায় নব্বই দশকে তৃষ্ণা বসাক একটি বিশিষ্ট নাম। একজন দ্রষ্টা।
সহায়ক গ্রন্থ ঃ
১) ঠান্ডা মাংস এবং আগুনের চুল্লি-তৃষ্ণা বসাক- তৌফিক জহুর (যৌথ কাব্যগ্রন্থ)
২) করতলে মহাদেশ- আবদুল মান্নান সৈয়দ
৩) আল মাহমুদ ও অন্যান্য- তৌফিক জহুর

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

পুরাতন খবর

SatSunMonTueWedThuFri
      1
23242526272829
30      
  12345
20212223242526
2728293031  
       
15161718192021
2930     
       
     12
24252627282930
       
2930     
       
    123
       
    123
25262728   
       
     12
31      
   1234
262728    
       
  12345
2728     
       
   1234
       
     12
31      
1234567
891011121314
15161718192021
2930     
       
    123
11121314151617
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
      1
2345678
23242526272829
3031     
      1
       
293031    
       
     12
10111213141516
       
  12345
       
2930     
       
    123
18192021222324
25262728293031
       
28293031   
       
      1
16171819202122
30      
   1234
       
14151617181920
282930    
       
     12
31      
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
       
© All rights reserved © MKProtidin.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com