বিশেষ প্রতিনিধি:গ্রামীণ ব্যাংকের শীর্ষ কর্তার আত্মীয় হওয়ার সুবাদে একের পর এক যৌণ হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েও বরগুণার বেতাগী শাখার কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। বরং ওই কর্মকর্তার যৌণ হয়রানির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় ক্ষুব্ধ কর্তৃপক্ষ অপরাপর সাত কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করেছেন। এখানেই ক্ষ্যান্ত হননি শীর্ষ কর্তা, তিনি নিরপরাধ সাত কর্মকর্তাকে উপুর্যপরি হয়রানি চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। যৌণ হয়রানিকারী কর্মকর্তার পক্ষ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারসহ অবৈধ দাপট দেখানোর অভিযোগ তুলেছেন একাধিক মানবাধিকার সংস্থা। এরইমধ্যে হিউম্যান এইড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গ্রামীণ ব্যাংকের বেতাগী শাখায় সেকেন্ড অফিসার হিসাবে মোঃ মোশাররফ হোসেন যোগদানের পর থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্যরা অনেকেই তার যৌণ হয়রানির কবলে পড়ছেন। তিনি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে যৌণ হয়রানি চালালেও তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার সাহস পান না কেউ। বিভিন্ন সমিতিতে ঋণের টাকা আদায় করতে গিয়েও মোশাররফ হোসেন সংশ্লিষ্ট নারী সদস্যদের সঙ্গে প্রকাশ্যেই অশালীন আচরণ করেন, নোংরা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। অনেকের গায়ের ওড়না এমনকি পরিধেয় পোশাক পরিচ্ছদ ধরে টানাটানির মতো চরম অসভ্যতারও শিকার হচ্ছেন সমিতির সদস্যরা। কিন্তু এসব ব্যাপারে কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেই তাকে ঋণ বকেয়ার দায়ে মামলা হয়রানির ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখেন মোশাররফ।
বেতাগীর গ্রামীণ ব্যাংকের আওতাভুক্ত গ্রামের ভুক্তভোগী মহিলারা অভিযোগ করে জানান, তাদের অনেকের স্বামী চাকুরীসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন, আবার কারো স্বামী বিদেশেও থাকেন। স্বামীর অবর্তমানে থাকা নারীরাই মূলত মোশাররফের যৌণ হয়রানির বেশি শিকার হন। তাদেরকে মোশাররফ হোসেন গভীর রাতে ফোন করে তার সাথে যৌন মেলামেশা ও অবৈধ সম্পর্ক করার প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে ত্যক্ত বিরক্ত করে চলছেন।
গ্রামীণ ফোন সমিতির সদস্য এক প্রবাসীর স্ত্রীকে গভীর রাতে ফোন দিয়ে সীমাহীন উত্যক্ততা চালিয়ে তার জীবন দূর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। ভুক্তভোগী নারী প্রতিবাদ করে এমনকি অনুনয় বিনয় করে তার সুখময় দাম্পত্য জীবন ভিক্ষা চেয়েও রেহাই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। ভুক্তভোগী ওই নারী তার উপর চালানো অব্যাহত যৌণ হেনস্তার বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরে মোশাররফ হোসেনের অশালীন সব প্রস্তাবনার অডিও রেকর্ডও সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেন। তারপরও তিনি মোশাররফ হোসেনের হয়রানির থাবা থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
এদিকে বেতাগী পৌর এলাকারও বিভিন্ন সমিতির ঋণ প্রার্থী তরুণিদের সহসা ঋণ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে ‘অন্য কিছু পেতে চাওয়ার’ প্রস্তাব দিচ্ছেন ওই কর্মকর্তা। রাত বিরেতে ফোনে উত্যক্ত করা নিয়ে অনেক বাড়িঘরে রীতিমত দাম্পত্য কলহের সূত্রপাত ঘটেছে। এসব অভিযোগ উল্লেখ করে অভিযুক্ত গ্রামীণ ব্যাংক কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি জানান, এ ব্যপারে গ্রামীণ ব্যাংকের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। এরপরও একাধিক ভুক্তভোগী নারীর কথা তুলে প্রশ্ন করা হলে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন মোশাররফ হোসেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তার ভগ্নিপতি দাবি করে বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে তাদের ‘মজা’ বুঝিয়ে দেয়া হবে।
যৌণ হয়রানিকারী কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনের এ হুমকি প্রদানের ৭২ ঘন্টার মধ্যেই গ্রামীণ ব্যাংকের পটুয়াখালী এরিয়ায় দায়িত্বরত সাতজন পদস্থ কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করার ঘটনা ঘটে। এরিয়া অফিস সূত্র জানায়, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে অজ্ঞাত কারণে একের পর এক কর্মকর্তাকে দূরবর্তী এলাকায় বদলি করে তাদের বিরুদ্ধে নানারকম প্রতিষ্ঠানিক হয়রানিও চালানো হচ্ছে। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অভিযুক্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বেতাগীতে বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।
মানবাধিকারের তদন্ত দল বরগুণায়
এদিকে ভুক্তভোগী নারীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হিউম্যান এইড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল বরগুণা, বেতাগী ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান চালান। সংস্থাটির জেনারেল সেক্রেটারী সেহ্লী পারভীন দেশপত্রকে জানান, ভুক্তভোগী নারীরা মারাত্মক পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। ঘরে ঘরে দাম্পত্য কলহেরও সূত্রপাত ঘটেছে। অথচ এন্তার অভিযোগ থাকা সত্তেও গ্রামীণ ব্যাংকের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা কেন অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না তা মানবাধিকার তদন্ত দলকে রীতিমত অবাক করেছে। সেহ্লী পারভীন আরো জানান, তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট যৌণ হয়রানিকারী কর্মকর্তাসহ গ্রামীণ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তাকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি নিয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও মন্তব্য করেছেন হিউম্যান এইড ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল সেক্রেটারী।