দাকোপ,খুলনা পানিরও তো একটা দাম আছে। কিন্তু তরমুজের তার চেয়ে দাম কম। আমি ১০ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলাম। মোটেও বিক্রি হয়নি। তরমুজ ক্ষেতেই পড়ে রয়েছে।
খুলনার দাকোপের আনন্দনগর গ্রামের তরমুজ চাষী শেখ আবু সাঈদ কান্নাভরা কণ্ঠে ‘মানুষের কল্যাণে প্রতিদিন’ কে কথাগুলো বলেন।
এ সময় তিনি আরও বলেন, ৫-১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ ক্ষেত থেকে ১০-২০ টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। সেই তরমুজ বাজারে ৩০-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাষীর কাছ থেকে কম দামে তরমুজ কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
একই গ্রামের চাষী কামরুল বলেন, ১০ বিঘা তরমুজ কেটে বসে আছি। কোথায় যাবো,কি করবো ভেবে পাচ্ছি না হতাশ হয়ে পরেছি। ঢাকা নিয়ে যেতে ২৫-৩০ হাজার টাকা পরিবহন খরচ। তরমুজের কোন দাম নেই। যা খরচ করেছি তার চার ভাগের একভাগ দামও পাচ্ছি না।
ছোট চালনার চাষী বাবুল শেখ বলেন, আমি পাঁচ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলাম। কোন তরমুজ বিক্রি করতে পারিনি। কেউ দামই বলে না। বাজারে তরমুজের দাম হলেও ক্ষেত থেকে তরমুজ নিতে কোন ব্যাপারী আসে না। আমার দুই ভাইয়ের ক্ষেতেও তরমুজ পরে রয়েছে। ক্ষেতেই তরমুজ পচে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। খরচ ওঠাতে পারব কিনা সে দুশ্চিতায় আছি।
বটিয়াঘাটার গঙ্গারামপুরের চাষী আরুণী সরকারের মেয়ে বিথি সরকার বলেন, আমার বাবা ৮ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছিলেন। এখন তরমুজ ক্ষেতেই পড়ে রয়েছে। কেউ কিনতে আসছে না।
পাইকগাছার উপজেলার গড়ইখালী এলাকার তরমুজ চাষী শাফায়াত হোসেন বলেন, বর্তমানে এই অঞ্চলের এক মহা- বিপদের নাম তরমুজ। তরমুজের মৌসুমেও বিক্রি করতে না পেরে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে কৃষক। মাঠে তরমুজের ঢল, বাজার মূল্য একেবারেই নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তরমুজ। আড়তে নিয়েও দাম পাচ্ছেনা কৃষক। মহা এক কালোবাজারি সিন্ডিকেটে আবদ্ধ কৃষকেরা। দেখার কেউ নেই। ক্ষেত থেকে ট্রাকে আড়তে পৌঁছাতে ১৫/২০/২৫ হাজার টাকা, আড়তদারি ১০% লেবার খরচ,আড়তে বিক্রির পর ভাড়া মেটাতে পারছেনা কৃষক। আড়ত থেকে পালিয়ে আসছে কৃষক। নিজেও হচ্ছে সর্বশান্ত। সুদে মহাজন এবং এনজিওর চাপে হচ্ছে এলাকাছাড়া। সাংসারিক বিপর্যয়, সবমিলে এক মহা বিপর্যয়ের নাম তরমুজ।
তরমুজ চাষীরা বলছেন, পানির দরে তরমুজ, নীরবে চোখের পানি ফেলছেন দরিদ্র কৃষকরা। এ বছর বাম্পার ফলন হওয়ার পরও বিক্রি করতে না পেরে এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা। রোজার পরে তরমুজের দাম পড়ে গেছে। ক্ষেতে তরমুজের কোনো ক্রেতা নেই। তাই বেচা-বিক্রিও বন্ধ। ক্ষেতে বিক্রি করতে না পারায় কৃষকরা তরমুজ নিয়ে ঢাকায় ও খুলনায় আসছেন। কিন্তু সেখানেও কাঙ্খিত দাম মিলছে না। খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে তরমুজের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও তরমুজের কোন মূল্যই বলছে না ব্যাপারীরা। আড়তে নিয়ে ৪/৫ দিন শত শত ক্ষেত মালিক আড়ত মালিকদের সাথে ধর্না দিয়ে সম্পূর্ণ লস করে শূণ্য হাতে বাড়ি ফিরছে। দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার কৃষক সর্বশান্ত হতে চলেছে। গতবছর তরমুজের দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর অনেকে বেশি জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন যারা তারা আরও বেশি ক্ষতিতে পরেছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খুলনা জেলায় এবার সাড়ে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, এবছর জেলায় ১৩ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। সবচেয়ে বেশী দাকোপে সাত হাজার ৬২৫ হেক্টরে। এছাড়া বটিয়াঘাটায় তিন হাজার ৬০০, পাইকগাছায় এক হাজার ৫১০, কয়রায় ৮৯৫, ডুমুরিয়ায় ৩৫০, রূপসায় পাঁচ, তেরখাদায় তিন ও ফুলতলা উপজেলায় এক ও মেট্রো থানায় আরও এক হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।
সিনিয়র খুলনা জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহরিয়ার আকুঞ্জী Mkprotidin.com কে বলেন, চাষীরা তরমুজ মাঠ থেকে বিক্রি করতে না পেরে মোকামে নিয়ে আসলে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় তারা কাঙ্খিত দাম পাচ্ছেন না। দাকোপ ও বটিয়াঘাটার কিছু কৃষকের তালিকা নিয়েছি। আমাদের কিছু উদ্যোক্তা রয়েছে তাদের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষেত থেকে তরমুজ কেনার ব্যবস্থা করছি। গতবছর এভাবে বিক্রির মাধ্যমে কৃষকদের কিছু লাভ হয়েছিল।
১১/৫/২০২২