সারাদিন অনেক ঝামেলা গেছে, খুব টায়ার্ড লাগছে, বোধহয় সবাই ঘুমিয়ে গেছে। বাসার ভেতরে পা রাখতেই বুঝলাম একজন পড়ুয়া তখনও জেগে…
: বাবা, একটা প্রশ্ন করবো?
: হ্যাঁ, শিয়র, বলো বাবা
: তুমি, ঘন্টায় কত ইনকাম করো ?
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, এ কেমন প্রশ্ন! এটাতো তোমার সাবজেক্ট না, এসব কেন জিজ্ঞেস করছো?
: প্লিজ, শুধু জানতে চাচ্ছি, বলোনা
বাবা ঘন্টায় কত?
: এই ধরো ২০০০ বা ২২০০ টাকা
: ও আচ্ছা, (বলে মাথা নিচু করে
ফেললো, কয়েক সেকেন্ড পর মাথা তুলে খুব লাজুক ভাবে বললো,
: আমাকে ৮০০ টাকা ধার দেবে?
এবার আর মেজাজ কন্ট্রোল করতে পারলাম না,
: কি ফালতু খরচ করতে চাও? আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে যাও পড়তে বসো, কড়া করে বললাম, একটুও সময় নষ্ট করা যাবেনা রেজাল্ট ভালো করতে হবে…
মাথা নিচু করে চুপচাপ ওর রুমে গিয়ে দরজা ঠেলে দিলো।
এমনিতেই অফিসের নানান টেনশন, তার উপর ফিরতে না ফিরতেই অকাজের প্যাচাল!
ফ্রেস হয়ে একাই ডিনার সারলাম। আর সবার হয়তো আরও ঘন্টা চারেক আগেই হয়ে গেছে…
কিছু একটা মন থেকে মোটেও সরাতে পারছি না, ছেলেটা এমন কথা কেন বললো? ওতো কখনোই টাকা পয়সা চায়না। আর চাইবেই বা কেন? ওকে তো কখনো ডিসপ্লের পছন্দ হওয়া সুন্দর টি-শার্টেটির প্রাইস ট্যাগ দেখে আস্তে করে সরে আসতে হয়নি! মাস শেষ হবার পরও টিউশনির টাকা না পেয়ে আন্টির সামনে লাজুক হয়ে দাঁড়াতে হয়নি। তাহলে মাত্র ৮০০ টাকা চাইছে, তাও আবার ধার! কিন্তু কেন?
ওর রুমের সামনে গেলাম, ছিটকানি লাগায় নি, নক করে ঢুকলাম। জেগে আছে দেখেও বললাম…
: কি ঘুমাও নি?
: না বাবা
: মন খারাপ করেছ ?
: নাহ, বলেই হেঁসে ফেললো
পড়ার টেবিলে কয়েকটা রেষ্টুরেন্টের পুরাতন বিল। চকচকে হাজার টাকার মাঝে ছোট কয়েকটা নোট গুছিয়ে রাখা। হাজারের নোটটা সম্ভবতঃ গত চাঁদরাতে আমারই দেয়া সালামীর…
কপালে ভাঁজ পড়লো..
: আচ্ছা কাছে টাকা থাকতেও আবার টাকা চাইলে যে?
: না, কিছু কম আছে,
কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো, তোমার থেকে আটশ পেলে দু’হাজার পুরো হবে। সেটা তোমাকেই দেবো, বাবা, তোমার অনেক দামি সময় থেকে একঘন্টা সময় আমাদের বেচবে?
কি বলে ছেলেটা ! কি বলবো, শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।
: কালকে একটু আগে ফিরবে, সবাই একসাথে ডিনার করবো, তোমার একঘন্টা কিন্তু কিনে নিলাম…
এবার সত্যিই কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে গিয়ে কখন যে ওদের এতো দুরে ঠেলে দিয়েছি, মাথায়ই আসেনি। ভোর হতেই যন্ত্রের মতো ছোটা শুরু করি, ডুবে থাকি ফাইলে, এভাবেই সন্ধ্যা নেমে আসে। ফিরতে প্রায়ই রাত হয়ে যায়। এতটাই কমার্শিয়াল হয়ে গেছি যে, আজ নিজের সন্তানও টাকায় সময় কিনতে চায়..! মনেহচ্ছে, আজ আমি অনেক দুরের মানুষ! প্রিয়জনকে ভালোবাসার সময় টুকুও কাজের মাঝে হারিয়ে ফেলেছি, যাদের জন্য এত শ্রম দেয়া, তারাই যদি পাশে না থাকে তাহলে কিসের এই অর্জন?
আজ যদি আমি Hasan Hafizur Rahman মারা যাই কিংবা কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি তো অফিসে আমার চেয়ার ফাঁকা পড়ে থাকবে না, দ্রুত রিপ্লেসমেন্ট চলে আসবে। কিন্তু পরিবারের তো কোন রিপ্লেসমেন্ট হয় না। বাবার স্থান তো অন্য কাউকে দিতে পারবে না, বদলাতে পারবে না বাবার নাম… গর্ব করে আমার নামটা বলা কিংবা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখটা ওদেরই ভিজবে… এমন হাজারো কারণ রয়েছে পরিবারকে ভালোবাসার কিংবা ওদের পাশে থাকার, ওদের সাথে মুল্যবান সময় কাটানোর…. So পরিবারকে ♥ দিন…
© Hasan Hafizur Rahman
পুনশ্চ: কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিলে গেলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এটি নিছক গল্প।
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।