সমুদ্রপথে ভ্রমণে ঝড়ের সময় কিংবা অশান্ত সমুদ্র কতটা ভয়াবহ যারা সম্প্রতি ওয়েষ্ট ইন্ডিজ সফররত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নৌযানের ভিডিও টা দেখেছেন কিংবা ধীরাজ ভট্টাচার্যের “যখন পুলিশ ছিলাম” বইটিতে চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ জাহাজে করে যাওয়ার বর্ণনা পড়েছেন তারা বোধকরি অনুমান করতে পারবেন। সে সময় (১৯৩০-৩২) চট্টগ্রাম -কক্সবাজার – টেকনাফ সড়ক যোগাযোগ ছিলো না। সমুদ্রপথে ভ্রমণের কথা অনেক লেখকের বর্ণনাতেই পাওয়া যায়।
আলহাজ্জ খান বাহাদুর আহ্সান উল্লা মহোদয়ের সমুদ্র পথে হজ্জ-যাত্রার অভিজ্ঞতাঃ- (বানান ও বাক্যরীতি অপরিবর্তিত)
নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ নঙ্গর উঠাইল। দর্শকবৃন্দ আমাদের শুভ ও নিরাপদ যাত্রা কামনা করিলেন ও মোবারকবাদ দিয়া আমাদিগকে বিদায় দিলেন। করাচীর ধনাঢ্য মিঃ গোলাম হোসেন খাঁ পরিবারবর্গ সহ আমাদের জাহাজে চড়িলেন।
আমি জাহাজে দ্বিতীয় শ্রেনীতে যাইব মনস্থ করিয়া আসিয়াছিলাম, দুঃখের বিষয় উক্ত জাহাজে ১ম ও ৩য় শ্রেনী ব্যতীত অন্য accommodation ছিল না। সুতরাং প্রথম শ্রেনির টিকিট ৪৫০ টাকায় খরিদ করিতে হইল। মিঃ গোলাম হোসেন খাঁ পরিবারবর্গের প্রত্যেকের জন্য ১ম শ্রেনীর টিকিট লইয়াছিলেন। সুতরাং তাহাদের সহিত একত্রে থাকিবার সুযোগ হইয়াছিল। তিনি ছিলেন মিলিটারি রসদ সরবরাহকারী। তাঁহার সহিত নানাবিধ Dried vegetables (কপি, শালগম) প্রভৃতি কতকগলি টিন ছিল, এতদ্ব্যতীত কয়েকটা জীবন্ত দুম্বাও ছিল। শুষ্ক তরিতরকারী অল্প পরিমিত ভিজাইলে ফুলিয়া প্রচুর হইত।
মীর সাহেব (মীর একীনূদ্দিন, লেখকের গ্রামবাসী ও পুলিশ ইনস্পেক্টর *লেখকের পীর ভাই জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর) ছাহেব ৩য় শ্রেনীর টিকিট লইয়াছিলেন, সুতরাং তাহারা ডেকের উপর ছিলেন, আর আমরা ১ম শ্রেনীর যাত্রীগণ দ্বিতলে ছিলাম।
রন্ধনের ভার আমার উপর, আর রুটি তৈয়ারীর ভার ইনস্পেক্টরের উপর পড়িল। আমাদের সঙ্গে প্রচুর চাউল, ডাইল, ঘি, চিনি ও চা ছিল। আমি মধ্যাহ্নে খিঁচুড়ী পাক করিতাম আর রাত্রীর জন্য ইনস্পেক্টর ছাহেব রুটি প্রস্তুত করিতেন। পথিমধ্যে মাছ দুস্প্রাপ্য ছিল, সময় সময়ে ছাগ মাংস পাওয়া যাইত। মন্জিলে মন্জিলে কেবল জ্বালানী কাঠ ও পানি খরিদ করা যাইত।
জাহাজ সোকোট্রার নিকটবর্ত্তী হইলে সমুদ্রে বিরাট তরঙ্গ উত্থিত হইল। উত্তাল তরঙ্গ মধ্যে জাহাজ ভীষণ টলিতে লাগিল। আমাদের কামরার ভিতর যে সকল কাঁচের পাত্র ছিল, সব চুরমার হইল। অন্ধকারময় গভীর রাত্রি, কাহারও সহিত কাহারও সাক্ষাৎ ছিল না। দাঁড়াইয়া থাকা অসম্ভব ছিল, আমি হাঁটু গাড়িয়া জাহাজের শিকল ধরিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। ডেকের যাত্রীগণ কেহবা বিছানার উপর বমি করিতেছে, কেহবা ভয়ে মলমূত্র ত্যাগ করিতেছে। সে এক আজীব ও গরিব দৃশ্য! প্রতি মুহুর্তে মনে হইতেছিলো জাহাজ সমুদ্রে নিমগ্ন হইবে। কিন্তু খোদার অপার মহিমা, রাত্রির শেষ ভাগে ক্রমে আমরা সোকোটরা অতিক্রম করিলাম।
সোকোটরা (Socotra) একটী জলমগ্ন পাহাড়, তাই তাহার উপর উত্তাল তরঙ্গের উৎপত্তি হয়। কাপ্তেন সাহেব অতি সতর্কতার সাথে জাহাজ চালনা করিলেন, উপস্থিত বিপদ কাটিয়া গেল। প্রাতঃকালে সহকারী কাপ্তেন আমাদের মেজাজ পুরছী করিলেন, তখন আমরা অপেক্ষাকৃত সুস্থ্য হইয়াছি…
(চলমান)
** Socotra (সোকোত্রা দ্বীপ) ভারত মহাসাগরে আবস্থিত ৪টি দ্বীপের সমন্নয়ে গঠিত মালা। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে এখানে প্রায় ৮০০ প্রজাতির বিভিন্ন অদ্ভূত দর্শন প্রাণীর বসবাস। প্রায় ২ কোটি বছরের পুরানো কিছু গাছ এখানে আছে, যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। দ্বীপটি এলিয়েন আইল্যান্ড বা ভিনগ্রহবাসীদের দ্বীপ নামেও পরিচিত। ইতিপূর্বে ইয়েমেনের অংশ এই দ্বীপের অদ্ভূত দর্শন গাছ, যা কাটার পর রক্ত ঝরে সেই ড্রাগন ব্লাড ট্রি সম্পর্কে লিখেছিলাম।
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।