কখনো কখনো কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত মানব আত্মার জন্য শ্রদ্ধায় নতজানু হই। কারণ তাঁর সৃষ্টিকর্ম আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর হয়ে তমসাচ্ছন্ন পথে আলো দেয়। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নিয়ে যৎকিঞ্চিত পড়াশোনা করতে যেয়ে যখন গুগলের দুয়ারে কড়া নাড়লাম তখন চোখ স্থির হয়ে গেলো।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী(১৮৩৪-১৯০৩)ঃ
মোঘল রাজত্বের উত্তরসুরী ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। এই মহিয়সী নারী ছোটবেলায় পড়াশোনার প্রতি তাঁর ব্যাপক আগ্রহের কারণে তাঁর পিতা বাসায় গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করেন তাঁর জন্য। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর জ্ঞান অন্বেষণে দারুণ পারঙ্গমতার পরিচয় দেন। গৃহ শিক্ষক জনাব তাজউদ্দীনের সাহচর্যে তিনি দ্রুত বাংলা, আরবি, ফার্সী ও সংস্কৃত এই চারটি ভাষার উপর বুৎপত্তি লাভ করেন। ১৮৬০ সালে জমিদার সৈয়দ মোহাম্মদ গাজীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ জীবন শুরু হয়।যদিও বিবাহ জীবনে তিনি সুখী হতে পারেননি বলে জানা যায়। ১৮৭১ সালে সংসার থেকে আলাদা হয়ে যান যখন জানতে পারেন তাঁর স্বামীর পূর্বের স্ত্রী আছে। বিয়ের কাবিনের একলক্ষ একটাকা দিয়ে তিনি কুমিল্লার পশ্চিমগাঁও এ সাড়ে তিন একর জমি কিনে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। ১৮৭৩ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁও এ জমিদারী লাভ করেন। ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর মাতুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী হন। তিনি ছিলেন হোমনাবাদ পরগণার জমিদার। চিন্তা, কাজে তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে আধুনিক নারী। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার নানান অন্ধকার ও কুসংস্কার হটিয়ে তিনি কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনোযোগী হন। একজন বিচক্ষণ নারী তাঁর দূরদর্শিতার জন্য তিনি দারুণভাবে জমিদারিত্ব পরিচালনায় সফল হয়েছেন। তিনি নির্ভিকভাবে তাঁর শাসন কাজ পরিচালনা করেন। শেষ জীবনে ওয়ারিশদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন এবং নিজের জমিদারিটি পরিণত করেন ওয়াকফ এস্টেটে।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব। সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে নারী শিক্ষার প্রতি জোর দেন।
১৮৭৩ সালে ( বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর পূর্বে) নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে কুমিলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের মধ্যে এটি অন্যতম। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী পশ্চিমগাঁও এ একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য একটি ছাত্রাবাসও ছিলো। মাদ্রাসার ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরেরা ১৯৪৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত করেন। ১৯৬৫ সালে এটি রূপান্তরিত হয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা ডিগ্রি কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮২ সালে কলেজটি সরকারি হয়ে নামকরণ হয় নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ।তিনি মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার উপর জোর দিতেন। মেয়েদের হোস্টেলও নির্মান করেন এবং হোস্টেলের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করতেন জমিদারি আয়ের উৎস থেকে। মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তিনি পবিত্র মক্কায় সেই সময় ‘ মাদ্রাসা ই সওলাতিয়া’ ও ফোরকানিয়া সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহায়তা করেছেন। হিন্দু, মুসলিম সকল নারীর জন্য তিনি চিরটাকাল কাজ করে গেছেন। কুমিল্লা জেলার উন্নয়নে তদানিন্তন ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ডগলাস জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর কাছে ঋণ চাইলে তিনি তোড়া ভরতি টাকা দান হিসেবে প্রেরণ করেন।
শিক্ষার পাশাপাশি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ” ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল”। মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র হাসপাতাল, ১৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেকগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা, সড়ক নির্মাণ করে মানবতা ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি নওয়াব বাড়ির সদর দরোজায় দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্জ্ব পালনের সময় হাজীদের সম্মানে একটি মুসাফিরখানাও নির্মাণ করেন। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে জনহিতকর কাজেও তিনি প্রচুর অর্থ দান করেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামানায় যে ক’জন সাহিত্য চর্চা করে যশ খ্যাতি অর্জন করেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।কোলকাতার ঠাকুরবাড়ির ” সখি সমিতির” সদস্যাও ছিলেন তিনি। ইতিহাস পাঠে জানা যায় তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সমসাময়িক কালের মুসলিম গদ্য ও কবিতা লেখিকা। ১৮৭৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণযন্ত্র থেকে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর সাহিত্য গ্রন্থ ” রূপজালাল” প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর সঙ্গীত লহরী ও সঙ্গীত সার নামে আরো দুটো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা এখন দুষ্প্রাপ্য।
মহারাণী ভিক্টোরিয়া ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর সামাজিক ও নারী শিক্ষা ও অন্যান্য মহতী কাজের জন্য প্রথমে ” বেগম” ও পরে ” নওয়াব” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৮৯৯ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আদেশে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কে ” নওয়াব” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী নিবাসের নামকরণ করা হয় ” নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রী নিবাস”।
১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারী পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমান।
বাঙালি সংস্কৃতি কেন্দ্রের কর্ণধার ও নব্বই দশকের কবি আরিফ নজরুল ফোন করে যখন এই মহীয়সী নারীর নামাঙ্কিত পুরষ্কারের কথা জানালেন, তখন শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। ইতিহাসের একটা অধ্যায় হুড়মুড় করে সামনে চলে এলো।
লিটল ম্যাগাজিন উদ্যান সম্পাদনা, কবিতার জন্য পুরস্কার পেলেও প্রবন্ধে পুরস্কার এই প্রথম। কিন্তু এমন এক শ্রদ্ধাভাজন মহীয়সীর নামে এ পুরস্কার প্রদান করা হলো ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার তোপখানা রোডের ” বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ” মিলনায়তনে, ইতিহাসের সেই দিনগুলি সেলুলয়েডের ফিতায় আমার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিলো।
আমি সম্মানিত বোধ করছি।