“ঘরের কোণে মরিচ গাছ,
লাল মরিচ ধরে
তোমার কথা মনে হলে
চোখের পানি পড়ে”।
মর্মার্থ বদলে গেছে, বাজারে লঙ্কাকান্ড বাধানো মরিচ নাকি এদেশের নয়। সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে বঙ্গে পা রেখেছে চারশ বছর আগে।
তাহলে তার আগে আমরা কি ঝাল খেতাম না? হ্যাঁ, খেতাম আমাদেরও ঝালের উৎস ছিলো।
গোল মরিচ: যাতে সবচেয়ে বেশী ঝালের উৎস “পাইপারিন” বিদ্যমান। আর এর খোঁজেই জলে নেমেছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস, ইন্ডিয়া যাওয়ার জলপথ অাবিস্কারে। তিনি ভারত খুঁজে না পেলেও খুঁজে পান রেড ইন্ডিয়া আর কাঁচা মরিচ। গোল মরিচের মতোই স্বাদ, নাম পিপার।
চুঁই ঝাল: চই, চই মরিচ বা চুঁই ঝাল লতানো উদ্ভিদ বিভিন্ন অঞ্চলে জঙ্গলে জন্মাত। খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে মাংস রান্নায় এখনো প্রচলিত।
পিপুল : আদি ঝালের উৎস, একসময় এদেশের বনেবাঁদাড়ে প্রচুর পাওয়া যেত, তবে এখন তা ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার দাওয়াই হিসেবেই প্রচলিত।
আদা: মধ্যযুগীয় সাহিত্যে খাবারে ঝালের ব্যবহার নিয়ে যেটুকু জানা যায়, দ্বিজ বংশীদাস মনসামঙ্গলে হরিণের মাংস রন্ধনে লবঙ্গ আর মৎস রন্ধনে আদারসের কথা লিখেছেন,
“ধনিয়া সলুপা বাটি দারচিনি যত
মৃগমাংস ঘৃত দিয়া ভাজিলেক কত
বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মৎস দিয়া
শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া”
চন্ডিমঙ্গলে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর মহাভোজের বিবরণ,
“কটু তেলে রান্ধে রামা চিতলের কোল
রুহিতে কুমড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল
কটু তেলে কই মৎস্য ভাজে গন্ডা দশ
মুঠি নিঙারিয়া তথি দিলা আদারস”।
আর অনন্দামঙ্গলে পদ্মমুখী ব্রাহ্মন ভোজনে বড়ি সহযোগে আইড় মাছের ঝোল রাঁধেন, “আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ি”
ভাবা যায়, বাঙালির রন্ধনে কোথাও মরিচ ছিল না!!!
১৪৯২ সালে কলম্বাস রেড ইন্ডিয়ানদের চিনতে ভুল করলেও খুব দরকারী দুটো জিনিস চিনতে ভুল করেননি তা হলো তামাক আর পিপার। পরের বছর দিয়াগো আলভারেজ আমেরিকা থেকে স্পেনে মরিচের বীজ আনেন। আর ভাস্তো দা গামার চেনানো পথে পর্তুগিজদের হাত ধরে অন্যান্য ফল সব্জির সাথে মরিচেরও ভারতবর্ষে আগমন। কালিকট বন্দর হয়ে আদর্শ প্রেমিক সম্রাট শাহজাহানের সময় সপ্তদশ শতকে বঙ্গে মরিচের আগমন।
শুধু রান্নায় নয়, অশুভ শক্তি তাড়াতে সুতোয় শুকনো মরিচ বেঁধে ঘরবাড়ি দোকানে ঝুলিয়া রাখা, বেআইনী জনতা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের পিপার স্প্রে, লুকিয়ে থাকা অপরাধী বের হতে বাধ্য করতে মরিচ বোমা। সাপ কিংবা হাতি তাড়াতে মরিচ পোড়ানো ধোঁয়া ব্যবহার করা হয়।
বাগধারায় লঙ্কাকান্ড বলতে আমরা বিবাদ, হানাহানি, হুলস্থুল বাধানো ইত্যাদি বুঝি।বাজারে লঙ্কাকান্ড বাধানো মরিচের নাম কিভাবে লঙ্কা হলো তা কিন্তু আজও অজানা রয়ে গেছে (কেউ জানালে বাধিত হবো) তবে মরিচ নিয়ে প্রচলিত কিছু স্লোক কখনই ভোলার নয়,
“তুমি থাকো ডালে
আমি থাকি খালে
দেখা হবে দুজনের মরনের কালে…”
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।