বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কাজ হলো নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় গবেষণা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ গবেষণা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ের গবেষক শিক্ষার্থীরা। তাদের সুপারভাইজ করেন গবেষক শিক্ষকরা। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এভাবে গবেষণা কার্যক্রম চললেও ব্যত্যয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিএইচডি গবেষণার অনুমতি নেই। কেন নেই? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না।
একটা সময়ে এ নিয়ে দায়সারা কিছু অভিযোগ তোলা হতো। কাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষকদের মান নেই, এক বিল্ডিংয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, ডিগ্রি প্রদানে অস্বচ্ছতা ইত্যাকার নানা অভিযোগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু নিজেদের আন্তরিক প্রচেষ্টা আর পরিশ্রমে তথাকথিত ওইসব অভিযোগের জবাব বিভিন্নভাবে দিয়ে দিয়েছে।
মাত্র তিন দশক আগে যাত্রা শুরু দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার। দেশের ক্রমবর্ধমান জনশক্তিকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত করতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে সেক্টরটি। একসময় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন সংকটে দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না পেয়ে দেশের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিদেশে পাড়ি জমাত। পাশের দেশ ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকাগামী এসব শিক্ষার্থী প্রতি বছর দেশের অর্থ বিদেশে নিয়ে যেত পড়াকালীন খরচ চালাতে। এতে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ছিল উল্লেখ করার মতো। এভাবে দেশের মেধাও পাচার হয়ে যেত। কেননা বিদেশগামী এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর একটা বড় অংশই আর দেশে ফিরত না।
গত এক দশকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আস্থা রাখতে দেখা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন বাংলাদেশে। ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা পোর্টাল ‘বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে’ শিরোনামে এক আর্টিকেলে ইউজিসির বরাতে উল্লেখ করেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে বিদেশী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছিলেন ২ হাজার ৩১৭ জন। ওই একই রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের ৩২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের ২৬টি দেশের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এ তালিকায় রয়েছেন ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, লেবানন, তানজানিয়া, অস্ট্রিয়া, রুয়ান্ডা, জিবুতি, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও বাহরাইন থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। এমনকি করোনা প্যানডেমিকে যখন সব বন্ধ, তখনো বিদেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে। স্বাভাবিক কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিঃসন্দেহে দারুণভাবে সহায়ক।
বর্তমানে দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। রাজনৈতিক ডামাডোল, উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ যেখানে শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক পরিবেশ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে এতদিন, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্ঝঞ্ঝাট শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। নিয়মিত ক্লাস, নিয়মিত পরীক্ষা, কোনো সেশন জট নেই, ডিগ্রি ঝুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমন পরিবেশই পছন্দ অভিভাবকদের।
গবেষণা খাতেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিউএস, টিএইচইসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দারুণ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাড়িয়েও যেতে দেখছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
করপোরেট চাকরি-সংক্রান্ত সম্প্রতি একটি পরিসংখ্যান বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করপোরেট চাকরিতে অংশগ্রহণ অনেক বেশি। বৈশ্বিক অনেক প্রতিযোগিতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্জনও উল্লেখ করার মতো। এ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, অ্যামাজনের মতো বিশ্ববিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোয় সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। কাজ করছেন মহাজাগতিক গবেষণা সংস্থা নাসায়ও।
আন্তর্জাতিক কোলাবোরেশন, শিক্ষায় আধুনিক উপায়-উপকরণের সন্নিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দারুণ উন্নতি করেছে এ ক্ষেত্রটি। তাই বলাই যায়, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অনস্বীকার্য।
আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ অবস্থান এসেছে কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের স্বকীয় প্রচেষ্টায়। এখানে সরকারের কোনো অনুদান নেই, কোনো ফান্ড নেই। যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছেন, এমনকি এখান থেকে কোনো সুবিধা নেয়ার সুযোগও তাদের নেই। এত কিছুর পরও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক নয়। বরাবরই খাতটিকে দেখা হয়েছে বৈষম্যের চোখে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়তে উল্লেখযোগ্য কোনো খরচ লাগে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারকে খরচ করতে হয় ৬-৭ লাখ টাকা। এ টাকার উৎস কিন্তু জনগণ। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ে নিজের টাকায়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি সহযোগিতা না থাকলেও হস্তক্ষেপ আছে সীমাহীন। বৈষম্য আর অবহেলায় যথাযথ উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারছে না দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রদানকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এ বৈষম্য?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যোগ্য শিক্ষকরা রয়েছেন। যে অধ্যাপকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থীর গবেষণা সুপারভাইজ করতেন, সেই তিনিই বেসরকারিতে এসে আর পিএইচডি গবেষণার অনুমতি পাচ্ছেন না। বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত।
নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করা হয়। এছাড়া বিদেশ থেকে পিএইচডি অথবা দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করে আসা মেধাবীদের এবং করপোরেট দুনিয়ায় বাস্তব অভিজ্ঞদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে, যেন শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক এবং করপোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে সহজেই পরিচিত হতে পারে। নিবেদিতপ্রাণ তরুণ এসব শিক্ষক পাবলিকের শিক্ষকদের মতো নিজের প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি করার সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে মানবসম্পদ উন্নয়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
আমরা সরকারি উচ্চ পদে কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, করপোরেট লিডারদের যদি পিএইচডির সুযোগ দিতে পারতাম তাহলে তারা কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় এসে তাদের সারা জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারতেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের অনুমতির ব্যাপারে বিভিন্ন
পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখা হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ইউজিসি থেকে আশ্বাসও দেয়া হয়েছে বারবার। এত কিছুর পরও কোথায় যেন আটকে আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির অনুমতির বিষয়টি। আমি মনে করি, এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। সমন্বয় নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মধ্যে। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রের এ দুই অভিভাবক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় না হলে উত্তরণের কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না।
এ বছরেই প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল-শিক্ষা সংলাপে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিএইচডির আওতায় আনতে বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া করে এগোনোর প্রস্তাব দেন। যারা ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করবে, তারাই পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে পারবেন। যে বিষয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা আছে, তারা সে বিষয়ে পিএইচডি চালুর আবেদন করতে পারবে বলে তিনি অভিমত দেন।
আমি এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। প্রতিষ্ঠান ক্রাইটেরিয়ার পাশাপাশি শিক্ষক ক্রাইটেরিয়াও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। যেসব প্রাজ্ঞ অধ্যাপক একসময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা পরিচালনা করতেন তাদেরও গবেষণা তত্ত্বাবধানের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে একটি উচ্চ শিক্ষা কমিশন থাকা প্রয়োজন, যেখানে পিএইচডি নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা, নীতিমালা ও সময়সীমা নির্ধারণ করা যাবে।
শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা না গড়ে উন্নত দেশ গড়া যাবে না। আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও সম্পৃক্ত আছি। দুটি সেক্টরকেই তাই খুব গভীর থেকে দেখার, পর্যালোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। আমার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি বা বেসরকারি ক্যাটাগরিতে ভাগ করাই উচিত নয়। দুটি ভিন্ন পরিচালনা পদ্ধতি থাকলেও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্টা ও প্রত্যাশা একই। কার্য পরিচালনা ক্ষেত্রে তাই সুযোগ-সুবিধাও এক হওয়া উচিত। পিএইচডি ডিগ্রি পরিচালনার অনুমতি পেলে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আরো ভালো করবে সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রদানের সুযোগ তাই এখন সময়ের দাবি।
বর্তমান বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগতি একটা বিশাল আশার সঞ্চার করেছে। অথচ আমরা এখনো আমলাতান্ত্রিকতায় পড়ে আছি। প্রাইভেট সেক্টরকে অবহেলা করে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, দেশের কোনো উন্নয়নই সম্ভব হয়নি। প্রাইভেট সেক্টর ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়নের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু অবশ্যই প্রয়োজন সরকারের সুদৃষ্টি এবং সুযোগ তৈরি করে দেয়া। এ ধারণা বাস্তবায়ন ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষা শুধু নয়, কোনো সেক্টরেই অগ্রগতি সম্ভব নয়।
আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ পিএইচডি. ডি.লিট:
অধ্যাপক, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেসিডেন্ট, নর্দান এডুকেশন গ্রুপ