বিদায় সাদী মহম্মদ;
এই বাংলাদেশ আপনার বাবার রক্তে-ভেজা, আপনার মায়ের জীবনযুদ্ধের উপর গড়ে উঠা বাংলাদেশ। বিনম্র শ্রদ্ধা।”
-পাভেল রহমান, সাংবাদিক
“যে ঘরে সাদী মহম্মদের মৃতদেহ পাওয়া গেল, সেই ঘরটিতে বসেই গেল বছর মার্চ মাসে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের সুযোগ হয়েছিল। আমার ইন্টারভিউর জন্য ১৫ মিনিটই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি আমাকে আড়াই ঘন্টার ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন।
আমার মোবাইল ফোনটি চুরি হওয়ায় সেই রেকর্ড, ছবি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু স্মৃতিতে ভাসছে সেই কথাগুলো। স্বাধীন দেশে তার মায়ের মতো শহীদজায়াদের মূল্যায়ন কেন হলো না? সেই আক্ষেপই ঝরেছিল আধা ঘন্টার বেশি সময়। তিনি মনে করতেন, তার মায়ের মতো শহীদজায়া যারা, তাদের স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া উচিত।
সেদিন উনার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম, উনি বলেছিলেন- আরেকদিন এসো, মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। মা আজ একটু অসুস্থ আছেন। সেই শহীদজায়া মা ৯৬ বছর বয়সে মারা গেলেন কয়েক মাস আগে।
মাকে হারিয়ে সাদী মহম্মদ হয়তো বিষণ্ণ ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় হৃদয়-বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়ে কাটিয়েছেন অনেক অনেক বছর।
১৯৭১ সালে তার বাবাকে (শহীদ সলিম উল্লাহ) হত্যা করা হয়েছে তারই চোখের সামনে। সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি কিভাবে ভুলবেন তিনি? মায়ের লড়াই দেখে হয়তো তিনি সাহস পেতেন।
সেই মা যখন মারা গেলেন, হয়তো তিনিও জীবনের উপর থেকে সাহস হারিয়েছেন।
সাদী মহম্মদ কেন আত্মহত্যা করলেন? তা আমরা কেউই জানি না, জানবো না হয়তো কোনোদিন। কিন্তু ৭১ এর সেই ভয়াল স্মৃতি যে তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াতো, তা বুঝেছিলাম সেই আড়াই ঘণ্টার আলাপে।
সাদী মহম্মদের সঙ্গে সেদিন আলাপের পর থেকে আমি যখনই সলিম উল্লাহ রোড পার হয়ে বাসায় ফিরি, রাস্তার পাশের কবরস্থানটার দিকে তাকায় আর ভাবি এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গণকবর। তার পাশেই এখন রঙচটা কতশত বাড়ি, রেস্তুরা। অথচ এই কবরে অন্তত ২৫জনকে কুয়োর মতো একটা জায়গায় পুঁতে রাখা হয়েছে। তাদের প্রায় সবাই সাদী মহম্মদের স্বজন-প্রতিবেশি।
বাসার সামনের ঈদ গাঁর মাঠে তাঁর সামনেই জবাই করা হয়েছে তার খালাতো ভাইকে। সেই ভাইকে মারার আগে গলায় দড়ি দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে ঘুরানো হয়েছে পুরো পাড়া।
চোখের সামনেই বাবাকে ছুড়ি মারা হয়েছে। সেই বাবাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি। অনেকটা সময় ছুরির আঘাতের পরও বেঁচে ছিলেন সলিম উল্লাহ। আহত অবস্থায় বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো বাঁচবো না। তোমরা বাঁচো’। বলে ধাক্কা দিয়ে সাদীকে পালাতে বলেছিলেন।
আহত বাবাকে রেখে তিনি সেদিন পালিয়েছিলেন। দূর থেকে দেখেছিলেন, বিহারীরা তার বাবাকে মারতে দলবেঁধে ছুটে আসছেন। এরপর কি হয়েছিল তিনি আর দেখেননি। নিজের জীবন বাঁচাতে পাশের বাড়িতে আশ্রয় চেয়েছিলেন। ভয়ে অনেকে আশ্রয় দেননি।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ এই বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়েছিল। ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার।
বাড়ির সামনেই মসজিদ, জুম্মার নামাজ থেকে কেবল ঘরে ফিরেছেন সলিম উল্লাহ। মসজিদে জড়ো হওয়া অবাঙালিরা গুজব ছড়ায়, সলিম উল্লাহর বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি ছোড়া হয়েছে।
জুম্মার নামাজে গিয়েই সলিম উল্লাহ বুঝেছিলেন, খুব খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। নামাজ না পড়েই বাসায় চলে এসেছিলেন সেদিন।
মসজিদে জুম্মার নামাজে কারা যেন উস্কানি দিয়েছে, এর পর থেকেই তাদের বাড়িতে ঢিল ছুঁড়া শুরু হয়। বিকেলের পর নিচতলায় আগুনও দেয়া হয়। রাত পর্যন্ত চলে হামলা। সবই নিজ চোখে দেখেছেন সেদিনের কিশোর সাদী।
সন্তানদের নিয়ে দু’তলা থেকে পাশের বাড়িতে লাফিয়ে পড়েছিলেন শহীদ সলিম উল্লাহর স্ত্রী। মচকে গিয়েছিল পা। সেই মচকানো পা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ছুটে বেড়িয়েছেন বাঁচার আশায়। স্বাধীন দেশে ফিরে এত বড় সংসার নিয়ে সেই মায়ের আরেক লড়াই চলে, যা পাশে থেকে দেখেছেন সাদী মহম্মদ।
জীবন যুদ্ধে এত সাহসের সঙ্গে লড়াই করার পরও জীবনের এই শেষবেলায় তিনি কেন আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিলেন? তার উত্তর হয়তো মিলবে না কোনোদিন। কিন্তু তাজমহল রোড দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ওই কবরস্থানটা, ঈদ গাঁ মাঠ আর পাশের পুরনো চারতলা বাড়িটা দেখলেই আমার চোখ জলে ভিজবে।
সাদী মহম্মদ সেদিন আড়াই ঘণ্টায় কত আলাপ যে করেছিলেন। বলছিলেন, এই বাড়িটাই মোহাম্মদপুরের প্রথম চারতলা বাড়ি। এক সময় এই বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বিকেলবেলা তারা দূরবীন দিয়ে ডিআইটির ঘড়িটায় দেখতেন কয়টা বাজে? পরে অনেক উঁচু উঁচু ভবন হওয়ায় আর দেখা যায় না। এ কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম।
শেখ কামাল ছিলেন তার বড় ভাইয়ের বন্ধু, প্রায়ই এসে রাতে থাকতেন। অনেক সময় বাসায় না বলেই চলে আসতেন। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী তাদের বাসায় প্রায়ই টেলিফোন করতেন।
সেদিনের সেই আলাপের পর আমি যখনই ওই ঈদগাঁ মাঠের পাশ দিয়ে যায়, কবরস্থানের দিকে তাকাই আর শ্রদ্ধায় নত হই। সলিম উল্লাহ রোডে এখন অনেক খাবারের দোকান হয়েছে। সেখানে গেলেই ভাবি সময় কেমন পালটে যায়?
কিন্তু সাদী মহম্মদ কি এত সহজে ভাবতে পারতেন? এই সলিম উল্লাহ রোড, তাজমহল রোড যে তার জীবনের কী ভয়ংকর অধ্যায়! তাই তো শহরের আধুনিক বিবর্তন হওয়ার পরও হইতো তিনি সেই পুরনো বাড়িটা ছাড়তে পারেননি। নতুন কোনো ফ্ল্যাটে উঠেননি। এই বাড়িটাকেও কোনো ডেভলপারকে দেওয়া হয়নি। আজন্ম তিনি এই বাড়িতেই থেকেছেন। আর এই বাড়িতেই তিনি নিজেই নিজের জীবনের যবনিকাও টেনেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে বাবা-চাচা-ভাই হারানোর পর সেই কিশোর সাদীর মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল, একাকী জীবনে সাদী মহম্মদ কি কখনো সেই বিষণ্ণতা থেকে বেরুতে পেরেছিলেন?
বিদায় সাদী মহম্মদ;
এই বাংলাদেশ আপনার বাবার রক্তে-ভেজা, আপনার মায়ের জীবনযুদ্ধের উপর গড়ে উঠা বাংলাদেশ। বিনম্র শ্রদ্ধা।”