নতুন কোনো শহরে বা জায়গায় গেলে সেই জায়গার আদ্যপান্ত, ইতিহাস, নামের উৎস জানা আমার চিরদিনের অভ্যাস। দিল্লিতে এসেছি, দিল্লির ইতিহাস কিছুটা জানি । সেই শৈশব থেকেই ইতিহাসে দিল্লি নিয়ে পাঠ্য বইয়ে পড়তে হয়েছে। দিল্লির একটি শক্তিশালী ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এটি ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে পরাক্রমশালী শক্তিশালী এবং সাম্রাজ্য ।
দিল্লি শহরের ইতিহাস মহাকাব্য মহাভারতের মতোই প্রাচীন। শহরটি আদিতে ইন্দ্রপ্রস্থ নামে পরিচিত ছিল, যেখানে পাণ্ডবরা বাস করতো । পরবর্তীতে আরও কিছু শহর যুক্ত হয় ইন্দ্রপ্রস্থের সাথে। অনেকের মতে শহর গুলি যেমন ফিরোজাবাদ, দিনপানাহ, লাল কোট, সিরি, কিলা রায় পিথোরা, তুঘলকাবাদ, জাহানপানাহ এবং শাহজাহানাবাদ, এগুলি দিল্লিরই অন্যান্য নাম। সর্বশেষে, স্বাধীনতার পর দিল্লি, আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে ওঠে জাতীয় রাজধানী শাসিত অঞ্চল, নয়াদিল্লি ধারণ করে ভারতের রাজধানী । দিল্লী নামের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু পৌরাণিক কাহিনী ও কিংবদন্তি রয়েছে। তাদের সবচেয়ে প্রচলিতটি হচ্ছে, ধিলু (Dhilu), নামের একজন রাজা যিনি ৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই স্থানে একটি শহর তৈরি করেছিলেন এবং নিজের নামে শহরটির নামকরণ করেছিলেন ধিলু । সেই ধিলু থেকে রুপান্তরিত হয়ে দিল্লি।
আমার ধারনা ছিল ইন্ডিয়াতে সবাই ইংরেজি বলাতে পারদর্শী। ধারনাটা ঠিক না। বহু ড্রাইভার, স্থানীয় শ্রমিক শ্রেণির কর্মজীবি লোকজন ইংরেজি বুঝতেই পারে না। ইংরেজিতে কথা বললে বিরক্ত হয়। হিন্দি সিনেমা দেখেছি প্রচুর। এখনও দেখি, কিন্তু পেটে নর্থ কোরিয়ান মিসাইল মারলেও মুখ দিয়ে হিন্দি শব্দ বের হয় না।
প্রচুর ট্যাক্সি ব্যবহার করতে হচ্ছে। আমার উনি সব কথার সাথে হ্যা-য় দিয়ে দিব্বি হিন্দি চালিয়ে যাচ্ছেন। ওরাও বুঝতে পারছে। আমার ছোট মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম হিন্দি ছবি দেখে দেখে তার হিন্দি তার মায়ের চেয়েও ভাল। আমার ক্ষেত্রেই শুধু ওদেরকে দোভাষী হিসাবে সাহায্য চাইতে হচ্ছে। কত আর মেয়ে আর মেয়ের মায়ের সাহায্য নেয়া যায়! ইজ্জতে লাগে। তাছাড়া কিছু প্রাইভেট ব্যাপার আছে মা-মেয়েকে বলতে অস্বস্তি লাগে। মা মেয়েকে পিছনে আরাম করে বসতে দিয়ে আমি ড্রাইভারের পাশের আসনেই বসি। খুব ইচ্ছে ড্রাইভারের সাথে খোশ গল্প করি। আমার কথাই বুঝে না, গল্প কেমনে করি!
খুব সম্ভব দিল্লির চাদনি চকে যাচ্ছি। চাদনি চকের ভিতরে যাওয়ার উপায় নেই। হিন্দিতে ড্রাইভারকে বললাম, “নাম তা পড়তা হ্যায় (এখানেই নামি)”। জানিনে কেন ড্রাইভার মুখ গম্ভীর করে আমার দিকে তীর্যকভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কিস লিয়ে”? পিছন থেকে মেয়ে হিন্দিতে বুঝিয়ে বললো “সামনে ভীড়, আমাদের এখানেই নামিয়ে দিন”! ড্রাইভার হাসি মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “সমঝতা হ্যায়”। কুতুব মিনার চত্তর ঘুরছি তিনজনে। ছোট টয়লেট পেয়েছে। পাশেই এক হকার কি যেন বিক্রি করছে। বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাইসাব পিশুখানা কুথায় হ্যায়”? আমার দিকে তাকিয়ে কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজনই বোধ করলো। কিছুই বুঝে নাই।! মনে হয় বেশি শুদ্ধ আর শালীন ভাষায় বলে ফেলেছি। অনেকক্ষন ধরে চিন্তা করে আমি আমার সর্বোৎকৃষ্ট হিন্দি ভাষায় বিনয়ের সাথে পাশের একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাই সাব, মুতাখানা কিধার হ্যায়”? লোকটি আমার বিনয়ে বোধহয় সাড়া দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো “তুম কিয়া বলতি হু সমঝতা নেহি”! আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ফেলেছি, আমার ভাষার স্টক শেষ। অগত্যা বডি ল্যাঙ্গুয়েজে কেনি আঙ্গুলের সাহায্য নিতে হলো। পাশে আরেকজন ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আর ইউ লুকিং ফর টয়লেট”? আঙ্গুল দিয়ে ইংগিত করে বললো, “গো স্ট্রেইট অ্যাহেড, দেন টার্ন লেফ্ট”।
নয়া দিল্লির ময়ূর বিহারের একটা হোটেলে আমার অবস্থান। ময়ূর বিহার পূর্ব দিল্লির একটি অভিজাত এলাকা । ময়ূর বিহার যমুনা নদীর খুব কাছে এবং এক সময় জায়গাটি ছিল ময়ুরদের বাসস্থান। জায়গার হোটেলটি থেকে অপুর্ব দৃশ্য বেলকোনিতে দাড়ালেই চোখে পড়ে । বিশাল মার্কেট কমপ্লেক্স, সাথে চোখ ধাধানো শপিং মল। এই মার্কেট চত্বরেই আছে বিশাল হলদিরামের ভবন। মেলবোর্নে থাকতে দেশি গ্রোসারি থেকে বাসার উনি মাঝে মাঝে শন পাপড়ি কিনে আনেন। আবার মাঝে মাঝে হলদিরামের চানাচুরও বাসায় দেখি । আমার ধারনা ছিল হলদিরাম বোধহয় শুধু চানাচুর আর শন পাপড়ি বিক্রি করেই জীবন ধারন করতো বা করে । ভাবলাম যাই, হলদিরামের অরিজিনাল শন পাপড়ি কিনে খাই। ভবনটিতে ঢুকে চোখ ছানাবড়া না ফুচকা-বড়া হয়ে গেল। খাদ্যে খাবারে সয়লাব। নিখুত ভাবে সাজানো। কাচের শেলফের ভিতর। সব কিছুই ঝকঝকে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। কি নেই! ডাল পুরি ঝালমুড়ি থেকে হালুয়া সন্দেশ পানতোয়া, পানি পুরি, ফুচকা, আলুটিক্কি, কাবাব, শতেক রকমের বেকারী প্রোডাক্টস, হরেক রকমের খাবার। সাথে আমার উনি আর কন্যা, তাদের চোখ ঝাল আইটেমের দিকে। হা-হু করতে করতে খেলো, আর কিছুক্ষন পর পর “ও মাই গড এত ঝাল কেন” । তাদের চোখে পানি, জানিনা এই পানি ঝালের কারনে নাকি তৃপ্তিতে, তবে পুরুষ আমি, বাবা আমি, তাদের এই আনন্দ দেখতে বড় ভালো লাগে।
হলদিরাম থেকে সিড়ি দিয়ে নেমে দাড়াতেই দুই পাশ থেকে দুটি পথ শিশু বালিকা ছুটে এলো। একজনের গলায় ঝুলছে ছোট্ট কাঠের ট্রে মতোন পাত্রে প্লাস্টিকের চুলের ক্লিপ, সেফটি পিন, লাল নীল রঙের প্লাস্টিকের ছোট ছোট চিরুণি। আরেক জনের হাতে রোদে মিইয়ে যাওয়া কিছু গোলাপ ফুলের আধা ফোটা কুড়ি।
মলিন জীর্ন জামা গায়ে। চোখে মুখে ধুলা বালি গাড়ির ধোয়ার আস্তর। একজন প্লাস্টিকের একটা ক্লিপ এগিয়ে দিয়ে বললো, “স্যার লিজিয়ে না”! বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মিশিয়ে বললাম, “আমার মাথায় তো চুলই নেই, ক্লিপ দিয়ে কি করব”? মেয়েটি বললো, “তোমার বিবি কে দিবা”! আমি বললাম “আমার বিবি ব্যবহার করে না”। আরেক পাশের মেয়েটি এই সুযোগ ছাড়ল না, সাথে সাথেই একটা গোলাপ ফুল এগিয়ে দিয়ে বললো, “এইটা নাও। ফুল সবাই পছন্দ করে”।
এই হয় আমার! আমি সহজে এদের কাছ থেকে সরে যাই না, সরতে পারি না। বাচ্চাদের এই আকুতি কষ্ট তাদের দুর্দশা আমাকে সব সময় পীড়া দেয়। দেশে গেলেও তাই হয়। একদিকে প্রাচুর্যের নহর, অন্য দিকে জীর্ন শীর্ন জনপদ ! কি দোষ ছিল এই বাচ্চাদের। এরা তো প্রাচুর্য্যের ঐ নহরেও জন্ম নিতে পারত। এদের জন্ম তো এদের ইচ্ছায় হয়নি। ভাগ্যগুনে আমি এই জনপদে জন্ম নিই নাই। উল্টোটাও তো আমার ক্ষেত্রে হতে পারত। এই বালিকাদের ভিতর একজন আমার কন্যাও তো হতে পারত। আমার জন্মতো এই উপমহাদেশেই, আমি তো এদেরই একজন। এই যে এরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, হয়তো একদিন উধাও হয়ে যাবে। কেউ কোনো দিন আর খোঁজ পাবেনা, এদের খোঁজ নেওয়ারও কেউ নেই।
তথ্যে প্রকাশ, ভারতে প্রতি আট মিনিটে একটি শিশু নিখোঁজ হয়। বার্ষিক ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (ইন্ডিয়া) (NCRB) “Crime in India” ২০১৯ রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৮ সালে ৭৩১৩৮ টি বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে । দিল্লিতে প্রতিদিন ৯ টি শিশু নিখোঁজ হচ্ছে, যার ৭৪ শতাংশ ক্ষেত্রে নিখোঁজ শিশুরা মেয়ে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যে আরও বলা হয়েছে বেশিরভাগ শিশুকে জোরপূর্বক শ্রম এবং পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হয়ে। আর অসুস্থ, দুর্বল স্বাস্থ্যের যারা তাদের শরীর থেকে অঙ্গ কেটে নিয়ে, শরীরের অবশিষ্টাংশ পুঁতে অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়।
বাচ্চা দুটির দিকে তাকিয়ে বলি, “শোন আমি তোমাদের কাছ থেকে কিছু নেব না”। তাকিয়ে দেখি দুজনের মুখই মলিন হয়ে গেছে। পকেট থেকে দুজনের দিকে দুটি ইন্ডিয়ান রুপির নোট দিতে দিতে বললাম, “তোমাদের জন্যে”।
অদুরেই কন্যা আর কন্যার মা অপেক্ষা করছে। ওদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে মনে বলি, “দয়াময় এই অসহায় বাচ্চাদের তুমি রক্ষা কোরো, তুমি ই এদের একমাত্র ভরসা”। হঠাৎ মনে হলো প্যান্টের পকেটে কে যেন কি ঢুকিয়ে দৌড় দিয়ে চলে গেল। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে বের করে এনে দেখি দুটি গোলাপের কুড়ি। অদুরেই সেই গোলাপ বালিকাটি আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। কি অপুর্ব দৃশ্য!!