লাইলী-মজনুর প্রেম যেভাবে অমর হলো…
“আমি এ দেয়াল পেরোই,
সে দেয়াল পেরোই
এ দেয়ালেও চুমু খাই,
সে দেয়ালেও
কিন্তু
ভেবো না এ ঘর ছিনিয়াছে মোর হৃদয়
ছিনিয়েছে সে, এ ঘরে থাকিতো যে”
লাইলীর কবরের পাশে নিথর পড়ে আছে মজনু মৃতদেহ, পাশে পাথরে খোদাই করে লেখা ছোট্ট কবিতাটি ভালোবাসার স্মারক হয়ে।
আরবের বনু আমির বেদুইন গোত্রের প্রধান সাঈদ আল মুলাওয়াহ, শীর্ষ ধনীদের একজন কিন্তু ঘরে সন্তান না থাকায় নেই মনে কোনও সুখ। সন্তানের জন্য দিন-রাত প্রার্থনা করে অবশেষে সফল, বাবা হন পুত্র সন্তানের। নাম রাখেন কায়েস ইবন আল মুলাওয়াহ। ছেলে বড় হলে বিদ্যা লাভের জন্য ভর্তি করেন মক্তবে। সেখানে একদিন এক অপরুপা পড়তে আসে, যার নাম লায়লা (অর্থ রাত্রি), পুরো নাম লায়লা বিনতে মাহদী (পরবর্তিতে লায়লা আল আমিরিয়া)। প্রথম দিন থেকেই লায়লার প্রেমে ডুবুহাবু খেতে থাকে কায়েস। লায়লার নামে কবিতা লেখা শুরু করে আর সেসব কবিতা মক্তবে, রাস্তায় মোড়ে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতে থাকে। কেউ শুনতে না চাইলেও তাকে জোর করে শোনাতো, এসব দেখে লোকজন তাকে ‘মাজনুন’ বা পাগল বলে ডাকতে থাকে।
আর এসব পাগলামী দেখে মেয়েটিও আস্তে অাস্তে… …
একদিন শাদীর পয়গাম পাঠালে লায়লার বাবা তা প্রত্যাখ্যান করে, কোনও মাজনুনের সাথে বিয়ে দিলে মেয়ের কলঙ্ক হতে পারে। প্রেমের ভূত নামানোর জন্য শীঘ্রই তায়েফের সাকিফ গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত ও ধনী বণিকের সাথে লায়লার বিয়ে দেওয়া হয় (টাকাওয়ালা বরদের বয়স কিন্তু একটু বেশীই হয়ে থাকে)। লালচে বর্ণের এই সুদর্শন পুরুষের নাম ওয়ার্দ আস -সাকফী, ডাকনাম ওয়ার্দ, যার অর্থ “গোলাপ”।
দুঃখ-শোকে মজনু গৃহত্যাগী হয়, মরু পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকে। পরিবার তার ফিরে আসার আশা ছেড়ে দেয়, তার জন্য প্রান্তরে খাবার রেখে যেত। মাঝে মাঝে তাকে একা দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে বা বালিতে লাঠি দিয়ে লিখতেও দেখা যেত।
লায়লা স্বামীকে নিয়ে উত্তর আরবের এক অঞ্চলে বসবাসকালে অসুস্থ হয়ে ওয়ার্দ মারা যায়। এবার মিলনের কিছুটা আশা জাগলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় বেদুইন রীতি, সদ্য বিধবাকে দু’বছর ঘর থেকে বের না হয়ে পালন করতে হবে স্বামীশোক। সেই দুঃখে লায়লা মারা যায় নিজ বাড়িতেই, খবর মজনুর কাছে পৌঁছালে সে লায়লার কবরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কবরে পৌঁছে কাঁদতে থাকে, ক্ষুধা তৃষ্ণায় একসময় ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে, লায়লার কবরের পাশে পড়ে থাকে মজনুর নিথর দেহ।
আরবিতে যেটি লায়লা ওয়া মাজনুন, ফার্সিতে সেটি লেইলি-মজনুন, হিন্দীতে লায়লা-মাজনু আর বাংলায় লাইলি-মজনু। এটি নজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনে মুলাওয়া এবং তার প্রেয়সী লায়লী বা লায়লা বিনতে মাহদী (লায়লা আল-আমিরিয়া) এর প্রেমকাহিনী নির্ভর প্রাচীন আরব্য লোকগাথা। এ কাহিনী পরবর্তীতে ফার্সি কবি নিজামী গঞ্জভীর পঞ্চকাহিনীযুক্ত আখ্যান কাব্যগ্রন্থ খামসা (পাঁচ)-এর তৃতীয় খন্ডে স্থান পায়। কবিতা লেখার অনেক আগে, প্রায় নবম শতক থেকে জনশ্রুতি আকারে যে গল্প মানুষের মুখে মুখে বেড়াতো, সেটিকেই কবিতায় রূপ দেন নিজামী। এজন্য তিনি সবগুলো জনশ্রুতি সংগ্রহ করেন। নিজামীর কবিতা অবলম্বনে অনেক ফার্সি কবি তাদের নিজেদের মতো করে গল্প রচনা করেন। যেমন আমির খসরু দেহলভী জামি প্রমুখ। মক্তবি শিরাজি, হাতেফি আর ফুজুলির সংস্করণগুলো তুরস্ক ও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রেম সম্পর্কৃত কাব্য হিসেবে প্রচুর জনপ্রিয় পায়।
ইংরেজ কবি লর্ড ব্রায়ন এটিকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘রোমিও জুলিয়েট’ বলে আখ্যায়িত করেন।
লাইলী-মজনুর কিছু কিছু গল্পে বাংলা সিনেমার ফ্লেবার পাওয়া যায়, যেমন মজনু আঘাত পেলে সে আঘাত লায়লার গায়ে লাগতো (যত দূরেই থাকুক না কেন) মজনু মার খেলে লায়লার গা থেকে রক্তও ঝরতো। শোনা যায়, বিয়ে করার জন্য মজনু লায়লার ভাই তাবরিজকে খুন করে, এ দোষে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড হয় মজনুর, তাই সে পলাতক হয়। এমনও শোনা যায়, প্রেমের কথা জানার পর মজনুকে খুন কবার জন্য লায়লার স্বামী ওয়ার্দ জঙ্গলে যায়।সেখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধে মজনুর বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় সে তখন ঘরে থাকা লায়লা ঢলে পড়ে মাটিতে। দু’ জন একইসাথে মারা যায়, একজন শরাঘাতে অন্যজন কলিজায় টান লেগে। পাশাপাশি কবর দেয়া হয় ওদের।
ভারতে এমনও জনশ্রুতি আছে, লায়লি-মজনু মারা যায়নি ওরা পালিয়ে রাজস্থানে চলে আসে, সেখানে তারা মৃত্যু পর্যন্ত ছিল। বিশ্বাস করা হয়, লায়লি-মজনুর মাজার রাজস্থানের অনুপগড়ে। জনশ্রুতি মোতাবেক, তারা দুজন বেহেশতে মিলিত হবে, সেখানেই তাদের বিবাহ হবে ও চিরকাল সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দেবে।
যুগে যুগে লোককথার এসব গল্পগুলো স্থান করে নিয়েছে মানুষের বিশ্বাসে, হয়তো আনন্দ দিয়ে দিয়ে যাবে আরও কয়েক শতক। লাইলী কিংবা মজনুর নামে ছেলেমেয়েদের নাম রাখা চলতেই থাকুক যুগের পরে যুগ। বিশ্বাসহীনতার এই যুগে লোককথা বিশ্বাস করে কথাদেয়া কিংবা কথারাখা মানুষগুলো যেন বিলুপ্ত না হয়ে যায়….
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশের আইন প্রশিক্ষক Hasan Hafizur Rahman