বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম:
কালিগঞ্জে আছিয়া লুতফর প্রিপারেটরি স্কুলে মা সমাবেশ অনুষ্ঠিত সলেমান মামুন ব্যারিস্টার সুমন দুই দিনের রিমান্ডে ডিএমপির ৩৮তম পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন শেখ মোঃ সাজ্জাত আলী বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা আলেমরাই এক দিন এদেশে নেতৃত্ব দেবেন।।ধর্ম উপদেষ্টা কে এই নতুন ডিএমপি কমিশনার? দৌলতপুরে বসতবাড়িতে ডাকাতির সময় মা-ছেলেকে হত্যার দায়ে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ আজ সার্চ কমিটির বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার কথা জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় জরুরি। – পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পাবনায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রিফিলের সময় বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের চালক নিহত, আহত একজন

সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া : সাহিত্যের অচেনা এক সন্ধ্যাতারা

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০২০, ১০.৩৩ এএম
  • ৪৪৮ বার পঠিত

সন্ধ্যার সানিধ্যে ঠিকানা খুঁজে প্রভাতের আলোপ্রভায় যে ফুল নিজেকে লুকোতে ব্যস্ত তার নাম সন্ধ্যামালতী। সন্ধ্যাবেলার যে তারাটি রাতের গভীরে লুকিয়ে পড়ে তার নাম সন্ধ্যাতারা। সম্ভাষণে তাঁকে আপনি সন্ধ্যামালতীও বলতে পারেন, বলতে পারেন সন্ধ্যাতারা। হ্যাঁ- সাহিত্যাকাশের অচেনা এক সন্ধ্যাতারার কথাই বলছি। নাম তাঁর সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। গত শতকের মানুষ তিনি- লিখতেন ‘বিবক্ষু’ ছদ্মনামে। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই, নানা অভিজ্ঞতায় ত্রিভুজের তিন বিষমবাহুর অসম কিছু অভিজ্ঞতা জমিয়ে তিনি লিখেছেলেন সাতকথার গল্প, সাতরঙের রংধনু। তাঁর নিজ জীবনটিও ছিল-‘নদী ভরা ঢেউ, জানে নাতো কেউ’- এর মতো। হয়তো জীবন-গল্পের সেই রূপময় বিন্যাসে কখনো তাঁর চোখ হয়েছিল উদাসী, কখনো উৎসাহী।

সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার জন্ম ১৯২০ সালে, আজ থেকে হাতে গুণে শতবছর আগের এক সন্ধ্যায়, ঠিক উঠোনের কোনে যখন সন্ধ্যামালতী ফোটে। পূর্বপুরুষেরা ইরাকের বাগদাদ থেকে এদেশে এসেছিলেন। তাঁর জন্ম দিনাজপুরে নানা বাড়িতে, নানা ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার ও দিনাজপুরের প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার। তাঁর পৈত্রিক নিবাস চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে। হাজীগঞ্জের সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষানুরাগী মৌলভী সৈয়দ আব্দুল মজিদ ছিলেন তাঁর দাদা। বাবা সৈয়দ সিরাজুল হক ছিলেন ঢাকা কলেজের আরবী, ফার্সী ও ইংরেজির অধ্যাপক। গোলাম কিবরিয়ার শৈশব কেটেছিল ঢাকার জগন্নাথ কলেজের বিস্তৃত সবুজ প্রাঙ্গণে। শৈশব থেকেই তাঁর ছিল সবুজ প্রাঙ্গনের মতো বিস্তৃত কোমল-প্রাণ হৃদয়। বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। শিকারেও তাঁর ছিল নির্ভুল নিশানা। ভ্রমন ছিল তার নেশা। সাহসী কৈশোরেই তিনি পেরিয়েছেন বেঙ্গালুর, আসাম আর দার্জিলিঙ এর পাহাড় পর্বত। মনের খোরাকে ঘুরেছেন এক দেশ থেকে আরেক দেশ। তিনি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের একজন সক্রিয় সৈনিক, লড়েছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষে।

অধ্যাপক বাবা আর গৃহিনী মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া ছিলেন সবার বড়। প্রথম সন্তান হিসেবে বেশ আদর-যত্নেই বড় হয়েছিলেন তিনি। বাবা-মায়ের উদারমনস্ক সাংস্কৃতিক জীবনদর্শন তাঁকে লেখালেখির প্রতি এক অমোঘ টানে আবদ্ধ করেছিল। শৈশবেই হয়েছিল তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি। একটি অভিজাত অথচ মার্জিত প্রতিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, পেয়েছিলেন লেখালেখির খোরাক আর পৃষ্টপোষকতা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল স্কুল ম্যাগাজিনে। তারপর বিভিন্ন সাময়িকী, পত্র-পত্রিকা ও বেতারে তাঁর অসংখ্য লেখা প্রকাশত ও প্রচারিত হয়। তিনি ভালোবাসতেন গান, জম্পেস গল্প আর আড্ডার মজলিশ ঘুরতো তাঁর পিছনে। ছিলেন মঞ্চ অভিনেতা। জীবনের বহুমুখী এসব চঞ্চলতা থেকে তিনি সাহিত্যের রস আহরণ করেছিলেন। আশৈশব ডায়রী লেখার অভ্যাস ছিল তাঁর। স্বাতন্ত্রিক ধাচে লেখা তাঁর রচনায় সমসাময়িক সামাজিক প্রত্যাশা আর হতাশার সুর একসাথে জড়িয়ে ছিল। তাঁর প্রাঞ্জল রচনাগুলোর নানা চরিত্রে রয়েছে সরলতা অথচ মুগ্ধকর দৃঢ়তা।

গোলাম কিবরিয়ারা একসময় থাকতেন জোনাকী সিনেমা হলের বিপরীতে নিজেদের ভাঙ্গা-বাড়ীতে। সামনে ছিল বাগান বিলাস, টিউলিপ আর রঙ্গনের সাজানো বাগান। জোনাকী হল সংলগ্ন এ পান্থশালাতেই সে সময় আড্ডা বসতো সাহিত্যের ক্লান্ত পথিকদের। লোকসঙ্গীত শিল্পী আবাসউদ্দীন আহমদ, সরদার জয়েনউদ্দীন, পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের মতো প্রবীণরাও এসে আলোকিত করতেন আড্ডার মজলিস। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন গোলাম কিবরিয়ার ভগ্নিপতি। ভাষা সৈনিক আবুল কাশেম, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর মতো শিক্ষাবীদ ও সাহিত্যিকের অনুরাগেও সিক্ত ছিলেন গোলাম কিবরিয়া। একবার গোলাম কিবরিয়ার এক বোনের অকালমৃত্যুতে শোকাহত জসিমউদ্দীন কবরের এপিটাফের জন্য কবিতা লিখে দিয়েছিলেন।

প্রতি রবিবার বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার নাটিকা প্রচারিত হতো। মঞ্চনাটকেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। নিয়মিত অভিনয় করতেন মঞ্চে। নিজের লেখা ‘কালের পুতুল’ নাটকে হাবিবুর রহমানের সাথে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল নাটকমহলে। বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক নাজমুল আলম ষেয়দ গোলাম কিবরিয়ার লেখালেখিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘বিবক্ষু’-একজন ছদ্মনামা বিদগ্ধ গল্পকার, যিনি বয়েসে প্রবীন এবং কর্ম-জীবনে, যুদ্ধে, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, দেশ-বিদেশে ও বন-জঙ্গলে প্রচুর পদচারনার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর গল্পগুলোর উপজীব্য বিষয়-বৈচিত্র্যই তাঁর বিভিন্নমুখী অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করেছে। গল্পগুলি সুখপাঠ্য ও সাবলীল সংলাপ সমৃদ্ধ, তার কারণ হয়ত এই যে লেখক একজন প্রবীন মঞ্চ অভিনেতা। ‘বিবক্ষু’ যত্নবান হলে শুধু একজন স্বার্থক গল্পকারই নয় একজন শক্তিশালী নাট্যকারও হতে পারবেন।’

গোলাম কিবরিয়ার রচনার সংখ্যা অজানা। তাঁর অন্যতম রচনা ‘দু’এ দু’এ পাঁচ’, ‘ম্যাগনোলিয়া’, ‘প্যারামবুলেটর’, ‘তৈমুর লং’, ‘আলাদিন’, ‘বাঘ শিকারের গল্প’, ‘শিল্পী’, ‘নীলনদ’ ইত্যাদি। তাঁর অসংখ্য পান্ডুলিপি প্রকাশের মুখ দেখেনি।

একজন মানবিক মানুষ ছিলেন সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। সমগ্র সৃষ্টির প্রতি ছিল তাঁর পরম মমতাজড়ানো ভালোবাসা। তিনি সবার মাঝে থেকেও নিঃসঙ্গ ছিলেন, ছিলেন ভাবুক প্রেমিক। তাঁর মননে ছিল অধ্যাত্ম অনুরণন। নিজস্ব ব্যস্ততায় তিনি ছিলেন কর্মবীর, কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ। তিনি মানুষ দরদী ছিলেন, ছিলেন সরল বিশ্বাসী। তিনি মানুসকে বিশ্বাসী করে ঠকেছেন বার বার, কিন্তু মনুষ্যত্বের তৃপ্তিতে জিতে গেছেন প্রতিবার।

গোলাম কিবরিয়ার অন্তিম চাওয়া ছিল- অন্তিম যাত্রা যেন ঘুমের মধ্যে হয়। হয়েছিলও তাই, ১৯৯৫ সালের ৩১ মার্চ জুমার রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সৈয়দ গোলাম কিরিয়ার মেয়ে সৈয়দা নাসরিন রোকসানা আজ নিজেকে সম্বরণ করছিলেন বারবার, শেষে এক ‘সীমাহীন গগনে’ বাবাকে নিবেদন করেছেন এভাবে-
মেঘে ঢাকা একটি
তারা
তুমি।
লক্ষ কোটি তারার মাঝে।
হাজার ফুলর মাঝে
পাতার আড়ে
ঢেকে পড়া
একটি গোলাপ তুমি।
ঝিলের জলে
শত পদ্মের মাঝে
একটি শ্বেতপদ্ম তুমি।
গহীন বনে
লক্ষ বৃক্ষের মাঝে
একটি শ্বেতচন্দন তুমি।
আলোহীন গভীর রাতে
আলোর দিশা তুমি।
অকুল সাগরের অতলে
ঝিনুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা
অমূল্য মুক্তা তুমি।
আমার পৃথিবীকে চেনা
তোমার দৃষ্টি দিয়ে
আমার যা কিছু শিক্ষা
সব- সব- সবই
তোমরা-ই
দীক্ষা।
আমার শিক্ষাগুরু তুমি
আমার চলার পথের
পাথেয় তুমি।

আজ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার পঁচিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। অচেনা সন্ধ্যাতারাটির হারিয়ে যাওয়ার আজ পঁচিশ বছর। সাহিত্যে তাঁর অবদান কম নয়। তবে দিনের আলোয় সন্ধ্যামালতীর যেমন লুকিয়ে যাওয়ার তাগিদ, অল্পায়ুর সন্ধ্যাতারার যেমন মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার তাগিদ; সেই একই তাগিদে মূলধারার সাহিত্য থেকে লুকিয়ে যাওয়া লেখক তিনি। তিনি বোধ হয় খুব অভিমানী ছিলেন বনজুঁইয়ের মতো। তাঁর পবিত্র স্মৃতির প্রতি আমার অতল শ্রদ্ধা। কাজী নজরুলের ভাষায় শেষ করি-
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
…গাইতে বসে কণ্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
বলবে সবাই- ‘সেই যে পথিক তার শোনানো গান না?

মো. মনিরুল ইসলাম
লেখক ও গবেষক
পরিচালক, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর

পুরাতন খবর

SatSunMonTueWedThuFri
      1
23242526272829
30      
  12345
20212223242526
2728293031  
       
15161718192021
2930     
       
     12
24252627282930
       
2930     
       
    123
       
    123
25262728   
       
     12
31      
   1234
262728    
       
  12345
2728     
       
   1234
       
     12
31      
1234567
891011121314
15161718192021
2930     
       
    123
11121314151617
       
  12345
20212223242526
27282930   
       
      1
2345678
23242526272829
3031     
      1
       
293031    
       
     12
10111213141516
       
  12345
       
2930     
       
    123
18192021222324
25262728293031
       
28293031   
       
      1
16171819202122
30      
   1234
       
14151617181920
282930    
       
     12
31      
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
       
© All rights reserved © MKProtidin.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com