চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাসের সূত্রপাত। এরপর প্রতিদিনিই ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে এই ভাইরাস। চীন পেরিয়ে এশিয়া-ইউরোপ সহ বিশ্বের ১৮৫ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত এর কোন টিকা বা ঔষধ নিশ্চিত ভাবে তৈরি না হলেও, বিভিন্ন দেশে এর ঔষধ তৈরীর জন্য রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাথমিকভাবে কিছু ঔষধ নিয়ে আশার আলো জাগিয়েছেন তারা। প্রচলিত কিছু জেনেরিক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কিছু কার্যকারিতা পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া ও চীনের গবেষকরা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, আইভারমেকটিন ও ফেভিপিরাভির ব্যবহারে নভেল করোনা ভাইরাসে কার্যকরীতা লক্ষ্য করেছেন। আশার আলো হলো আমাদের বাংলাদেশে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও আইভারমেকটিন ঔষধ আগে থেকেই উৎপাদিত হতো। যা দেশের চিকিৎসা চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হতো। উল্লেখিত জেনেরিক দুইটির মধ্যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধটি ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে আসলেও আমাদের দেশে এটি লোপাস নামক রোগের বিরুদ্ধেও ব্যবহার হয় এবং আইভারমেকটিন ঔষধটি ফাইলেরিয়া ও স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে গাইডলাইনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করতে বলেছে। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এসব ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। কোনোভাবেই নিজে নিজে ওষুধগুলো ব্যবহার করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও (ইউএসএফডিএ) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করতে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার অনুমোদন করেছে। চীন ও ফ্রান্সের ওষুধ উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ওষুধটি ব্যবহার করেছে। ভারতের মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন করোনা আক্রান্ত রোগীদের পাশাপাশি যারা ক্রমাগত করোনা আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসছেন বা সেবা দিচ্ছেন, তাদের প্রতিরোধক হিসেবে ওষুধটি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশে ইনসেপ্টা ও ডেলটা ফার্মা লিঃ নামক দুইটি ওষুধ কোম্পানি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদন করে থাকে। ইনসেপ্টা রিকোনিল নামে এবং ডেলটা ফার্মা লিঃ রিউমাফ্লেক্স নামে ওষুধটি বাজারজাত করে থাকে। এই দুইটি ওষুধ কোম্পানি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বিদেশেও রফতানি করে থাকে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আইভারমেকটিনের সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়েও আশার আলো দেখাচ্ছে গবেষকরা।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উঁকুন নাশক একটি ওষুধ করোনভাইরাসকে আটকে দিতে কাজ করছে। এটা খুবই চমৎকার হবে যদি সত্যিই এটা করোনার সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হেলথ অর্গানাইজেশন এই নাশক দিয়ে করোনা মোকাবেলার উপায় খুঁজছেন। ওষুধটি মূলত উঁকুন নাশক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অস্ট্রেলিয়ায় গবেষকরাও বিশ্বাস করেন যে এটি কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে উঁকুন নাশকটি মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভাইরাসটির মাত্রা ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে এবং এটি তিনদিন পরে ভাইরাসটি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে পেরেছে।
তবে মোনাস ইউনিভার্সিটি করোনাভাইরাস চিকিৎসায় আইভারমেকটিনের অধিকতর গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। আইভারমেকটিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন (ইউএসএফডিএ) অনুমোদিত একটি অ্যান্টি প্যারাসাইটিক ওষুধ। এটা অনেক দিন থেকে ফাইলেরিয়া ও স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে বেক্সিমকো ও ডেল্টা ফার্মা নামক দুইটি ওষুধ কোম্পানি এই ওষুধটি উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শুধু ডেলটা ফার্মা ওষুধটি ‘স্ক্যাবো ৬’ নামে উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। বেক্সিমকো ওষুধটির অনুমোদন নিলেও কোম্পানিটি এ ওষুধটির উৎপাদনে যায়নি। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আইভারমেকটিনের ব্যবহার অনুমোদিত নয়।
এসব ওষুধ ছাড়াও এজিথ্রোমাইসিন নামক একটি অ্যান্টিবায়োটিক করোনা চিকিৎসায় বেশ কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন এই অ্যান্টিবায়োটিকের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়ার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান।
এছাড়া জানা গেছে, ফ্যাভিপিরাভির ওষুধটি জাপানি কোম্পানি ফুজির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান তোয়ামা কেমিক্যাল তৈরি করেছিল ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য। সম্প্রতি ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ডেভেলপমেন্টের পরিচালক ঝ্যাং জিনমিন বলেছেন, দেশটির দুটি মেডিকেল ইনস্টিটিউশন ফ্যাভিপিরাভির প্রয়োগ করে দেখেছে, এটি করোনাভাইরাসজনিত কিছু লক্ষণ কমাতে কার্যকর। এর মধ্যে রয়েছে নিউমোনিয়া। ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’ লিখেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার খাদ্য ও নিরাপদ ওষুধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ফ্যাভিপিরাভিরের বদলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির তৈরি রেমডেসিভির নামের একটি ওষুধ করোনা চিকিৎসায় পরীক্ষামূলক ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এটি ইবোলা ভাইরাস চিকিৎসার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ কোম্পানি জাইলিড সায়েন্স। জাপানে ফুজির তৈরি ফ্যাভিপিরাভির ওষুধটির ব্র্যান্ড নাম অ্যাভিগান। এটি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করতে পারে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে জাপান।
গতকাল ৯ এপ্রিল ২০২০ ফুজি ফিল্ম কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট : কেনজি সুকেনো তার ইনফ্লুয়েঞ্জা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধটি “আভিগান ট্যাবলেট” (জেনেরিক নাম: ফেভিপিরাবির) কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নোভেল সার্স-কোভ-২ করোন ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে।
ফ্যাভিপিরাভির ওষুধটি মূলত ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য জাপানের ফুজি তৈরি করেছিল। পরে চীন করোনা ঠেকাতে এটি প্রয়োগ করে সুফল পায়। এরি মধ্যে চীন থেকে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) এনে বেক্সিমকো ফার্মা ও বিকন ফার্মা ওষুধটি তৈরি করে মজুত রেখেছেন।
বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস আগামী রোববার (১২ এপ্রিল) ওষুধটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসনে হস্তান্তর করবে। ওষুধটি সরকারকে সরবরাহ করার পাশাপাশি যে সমস্ত হাসপাতালে করোনা রোগী আছে সেখানেও সরবরাহ করা হবে। তবে এখনই ফার্মেসিতে সরবরাহ করা হবে না। ম্যাটেরিয়াল স্বল্পতার কারণে মাত্র ১০০ রোগীর জন্য ওষুধটি তৈরি হবে, তবে এ মাসের মধ্যেই ওষুধটি উৎপাদন বাড়াতে পারবে বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস যে সমস্ত হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি আছে সেখানে ওষুধটি পৌঁছে দেবে। প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম ৪০০ টাকা হলেও এখন এটি বিনামূল্যে আক্রান্ত রোগীদের সরবরাহ করা হবে।
ওষুধটি প্রস্তুতের পেটেন্ট জাপানের হলেও অনুন্নত দেশ হিসেবে তারা বাংলাদেশকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধটি প্রস্তুতের অনুমোদন দিয়েছে। যাতে সরকার চাইলে সরবরাহ করতে পারেন।
বেক্সিমকো ফার্মা ও বিকন ফার্মা এগিয়ে আসার পর আরও ছয়টি ঔষধ কোম্পানি ফ্যাভিপিরাভির উৎপাদনের জন্য ওষুধ প্রশাসনের প্রাথমিক অনুমোদন চেয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইনসেপ্টা ফার্মা, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস, ডেল্টা ফার্মা, ভেরিটাস ফার্মাসিউটিক্যালস, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এবং জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
সংশ্লিষ্ট ঔষধ কোম্পানিগুলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উৎপাদন করতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আদনান কবীর
এম ফার্ম, ফার্মাকোলোজি এন্ড ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি