বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজিদ মিয়ার শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ। বাঙালি জাতির এক গর্বিত ও আলোকিত মানুষ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী পরম শ্রদ্ধেয় ড. এম এ ওয়াজিদ মিয়ার মহাপ্রয়াণ দিবস আজ।পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। আজীবন বিজ্ঞান আর মানবিকতার চর্চা ড.ওয়াজেদ মিয়াকে নিয়ে গেছে অনন্য অবস্থানে।
ওয়াজেদ মিয়া ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।পারিবারিক পরিমণ্ডলে তিনি সুধা মিয়া নামেই পরিচিত ছিলেন। অসাধারণ মেধার অধিকারী সুধা মিয়া শৈশব থেকেই শিক্ষানুরাগী ছিলেন।পাতার ফাঁকে, পুকুরের জলে রোদের লুকোচুরি। এমন আলো-ছায়াঘেরা প্রকৃতির অমিত প্রাণশক্তি নিয়ে সুদূর রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তরুণ সুধা মিয়া।
মেধাবী, সাহসী, উদ্যমী, কর্মঠ কিন্তু একটু অন্তর্মুখী। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের সতীর্থরা, ছাত্ররাজনীতির বন্ধুরা সবাই দিনে দিনে টের পেয়ে যায় অন্তর্মুখী এই ছেলেটির মাঝে কী যেন একটা আছে। তাঁকে চিনতে আদতেই ভুল হয়নি কারো। ওয়াজেদ মিয়া নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। আজীবন বিজ্ঞানের সাধনায় নিমগ্ন, নির্মোহ এই বিজ্ঞানীকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের পরমাণু চর্চার বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। দেশে আণবিক গবেষণার পথিকৃৎ বলা হয় তাঁকে। তিনি পরমাণু গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন।
ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন পদে দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর গবেষণা কর্মের পরিধি ছিল বিস্তৃত। তিনি ফান্ডামেন্টাল ইন্টারেকশন এন্ড পার্টিক্যাল ফিজিক্স, নিউক্লিয়ার এন্ড রেক্টর ফিজিক্স, সলিড স্টেট ফিজিক্স, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম, হেল্থ এন্ড রেডিয়েশন ফিজিক্স, রিনিউবল এনার্জি ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষণা করেন। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের দু’বার সাধারণ সম্পাদক ও পাঁচবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া যে মাপের বিজ্ঞানী, তাতে তিনি সারাজীবন অনায়াসে বিদেশে উচ্চপর্যায়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে কাটিয়ে দিতে পারতেন। কারণ, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণা ও কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশের কাজে লাগানোকেই শ্রেয় বলে বিবেচনা করেছেন।
নিজের জীবনের সবগুলো কর্মময় বছরই ড. ওয়াজেদ নিবেদন করেছেন বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের পেছনের মানুষগুলোকে মহিমান্বিত করার কাজে। তিনি বলতেন, ‘একটা উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে সম্পদ অপ্রতুল, সেখানে একমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই জাতির জন্য সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারে।’ তিনি সম্মিলিত সক্ষমতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং আমাদের দেশের সম্ভাবনায় আস্থাবান ছিলেন। উন্নয়নে বিজ্ঞানের ভূমিকা এবং এ লক্ষ্য অর্জনে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
ড. ওয়াজেদ বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতে নীরবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। ষাটের দশকে তিনি ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং কিছু দিন জেল খাটেন। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের পাশে থেকে তাঁদের সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন।
ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ ৭ বছর নির্বাসিত জীবন কাটান।এ সময়কালে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার একমাত্র আশ্রয় ছিলেন তিনি। ড. ওয়াজেদ মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পদার্থ বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ছাত্রদের জন্য দু’টি গ্রন্থ রচনা করেছেন।এছাড়া তাঁর লেখা ৪৬৪ পৃষ্ঠার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ৩২০ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শিরোনামের গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত হয়। বহুল রাজনৈতিক ঘটনা সংবলিত এই দুটি গ্রন্থ সুধী পাঠকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
সমাজের চিরচেনা মানুষের গতানুগতিক মানসিকতার সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়া ছিল বরাবরই একটু তফাত। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়েও, রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর কাছাকাছি থেকেও কোনো দিন তিনি ক্ষমতাচর্চায় আগ্রহী হননি।ক্ষমতার উত্তাপের বিপরীতে তিনি ছিলেন স্থির, অচঞ্চল, নিভৃতচারী ও নিষ্কলুষ একজন। নিজের মেধা, শ্রম ও যোগ্যতায় তিনি ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছেন সত্যিকার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের প্রতিচ্ছবি। রংপুরের নিভৃত পল্লির সেই ছোট্ট সুধা মিয়া আজ নিজ গুণে দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে চিরভাস্বর। ২০০৯ সালের ৯ মে তাঁর নশ্বর দেহের মৃত্যু ঘটেছে বটে। কিন্তু আজীবন বিজ্ঞান আর মানবিকতার চর্চা সুধা মিয়াকে নিয়ে গেছে এক অনন্য অবস্থানে। তাঁর অবদানের কারণেই পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে এ দেশের মানুষ স্মরণ করবে চিরদিন।