নিউজ ডেস্কঃ
ইকবাল মাসুদ: করোনাভাইরাস স্বাস্থ্যখাতে খরচ বাড়নো ছাড়া আর উপায় নেই। দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কেমন হওয়া দরকার, করোনা-সঙ্কট তা নিয়ে ভাবনাচিন্তই বদলে দিয়েছে। অন্যদিকে করোনা-সঙ্কট ও লকডাউনের ফলে সরকারের আয় কমছে। করোনা যে ভাবে জীবনের অংশ হয়ে উঠছে, তাতে জনস্বাস্থ্য ও দেশের অর্থনীতির সঙ্কট দেখা দেবে তা অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ সনাক্ত হয়েছে গত ৮ই মার্চ ২০২০ এর মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণে পরিস্থিতি বেশ দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে। করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভিড ১৯ মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে আক্রান্ত করে ও একটা পর্যায়ে শ্বাসতন্ত্রকে অকার্যকর করে দেয়। এজন্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, শ্বাসতন্ত্রকে রক্ষার সতর্কতা অবলম্বন করে সবাই এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারে। শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছু কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। যেসব ব্যক্তির কো-মর্বিডিটি অর্থাৎ অন্য কোনও অসুখ রয়েছে, সেসকল ব্যক্তির করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেশী হতে পারে। এবং এসব ব্যক্তিরা আক্রান্ত হলে তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি।
করোনাভাইরাস সৃষ্ট রোগ কোভীড ১৯ প্রতিরোধী ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ হল শ্বাসতন্ত্র। আমাদের শরীরের ফুসফুস শ্বাসের সঙ্গে যে সব দূষিত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে তাদের শরীর বাইরে বের করে দিয়ে ফুসফুসকে সচল রাখার চেষ্টা করে। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের শরীর সুস্থ থাকে। তাই স্বাভাবিক ভাবে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমে গেলে ফুসফুসের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। আর করোনাভাইরাসের প্রধান লক্ষ্যই হল ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রকে অকার্যকর করে দেয়া। কাজেই যে কোন মূল্যে প্রত্যেক ব্যক্তির এই করোনাকালে লক্ষ্য হওয়া উচিত শ্বাসতন্ত্রকে সুস্থ রাখা।
ফুসফুসকে সুস্থ রাখার বিষয়ে তামাকজাতদ্রব্যের ব্যবহার ছাড়ার একটা বড় ভূমিকা আছে। বিশেষ করে যারা ধূমপান করতে করতে ফুসফুস এমনিই দূর্বল হয়ে গিয়েছে বা হাঁপানি-সিওপিডি জাতীয় শ্বাসের অসুখ আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সময় ফুসফুসের যতেœর কথা মাথায় রেখে ধূমপান ত্যগ করতে হবে।
‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা যায়, অধূমপায়ীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সংখ্যক ধূমপায়ী জটিল অবস্থায় ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাদের কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হয়েছে। এরপরও তাদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছেন।
এছাড়া ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) এক গবেষণা বলছে, দিনে একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। স্ট্রোক বা মস্তিস্কে ক্ষরণের ঝুঁকিও বাড়ে ৩০ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো বেশি, ৫৭ শতাংশের মত। কোভীড ১৯ কারণে কিছু দেশে অতিরিক্ত ধূমপায়ীদের মধ্যে ধূমপানের মাত্রা কমানোর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তারা মনে করছেন এতে তাদের ঝুঁকি কমছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ধূমপান কমানো নয় ধূমপান একবারে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সাথে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাও সুর মিলিয়ে বলছে, যারা ধূমপান করেন তাদের কোভিড ১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি হবার সম্ভাবনা আছে। এবং তারা আরো বলেছে ধূমপান করার সময় হাতের আঙুলগুলো ঠোঁটের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে হাতে বা সিগারেটের গায়ে লেগে থাকা ভাইরাস মুখে চলে যাবার সম্ভাবনা বেশী থাকে। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা করোনাকালের প্রথম থেকেই ধূমপায়ীদের সতর্ক করে চলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা প্রভাব অনেকটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের আশঙ্কা থাকে প্রবীণ এবং অন্যন্য অসুখের চিকিৎসা চলছে এমন ব্যক্তিদের। কারণ, এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনায় দুর্বল হয়। তবে তরুণদের করোনা-আক্রান্তের সম্ভাবনাও খারিজ করে দেওয়া যায় না। ধূমপান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, তাই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি। এজন্য তামাক সেবন ও ধূমপান করোনা কেন, অন্য অসুখও হতে পারে।
এখন আমরা যদি দেখি, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার জনিত সমস্য কতটকুু বা এর ক্ষতির পরিমান কি তাহলে দেখব Global Adult Tobacco Survey ২০১৭ হিসাব মতে বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব) মানুষ তামাক সেবন করে। নারীদের মধ্যে এই হার ২৫.২ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ। দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক বা গুল, জর্দা, সাদাপাতা ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে নারী ২৪.৮% এবং পুরুষ ১৬.২% যা মোটের হিসেবে ২০.৬ শতাংশ এবং ধূমপায়ী ১৮ শতাংশ এর মধ্যে পুরুষ ৩৬.২%, নারী ০.৮%।
ঐ পরিসংখ্যন মতে বিশ্বের তামাক ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো অন্যতম। তামাকের ব্যবহার ও অন্যান্য কারণে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের প্রকোপও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হৃদরোগে কারণে মৃত্যুর ৩০ শতাংশের, ক্যান্সারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশের, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশের এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী।
অন্যক্ষেত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে চিকিৎসা ব্যায় বহুগুণে বেড়ে গেছে যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল বোঝা। এছাড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবেও দেশ ব্যপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) ২০১৩ গবেষনা অনুসারে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালমৃত্যু বরণ করে। তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়। এভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ।
দেশে তামাকের এই ভয়াবহতা প্রতিরোধে ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয় এবং ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে আরও যুগোপযোগী করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা পাস করা হয়েছে। এতো কিছুর পরেও তামাক কোম্পানির কৌশলের কাছে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও নীতিমালাসহ সবকিছুর বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়ছে। আর এই করোনাকালে তামাক কোম্পানির অপ্রতিরোধ্য বানিজ্যিক কৌশল ধূমপায়ী বা তামাকসেবীদের করোনা আক্রান্তের ঝুকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতের কোন অমিল নেই। করোনা ভাইরাস যেহেতু শ্বাসতন্ত্র বা রেসপিরেটরি সিস্টেমকে সরাসরি আক্রমণ করে, তাই ধূমপায়ীদের ঝুঁকি এক্ষেত্রে বেশিই।
এরই মধ্যে দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ দেখা গিয়েছে এবং করোনাভাইরাস দেশের সকল জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সরকারের আরও সতর্ক থাকা উচিত। এই মহামারিকালীন সময়ে তামাকজাতদ্রব্য বিপণন ও বিক্রয় অব্যাহত থাকলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর মারাত্মকভাবে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এতে করোনাভাইরাস সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে মহামারি চলাকালীন জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সকল তামাকজাতদ্রব্য বিপণন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে তামাক বিরোধী সংগঠন গুলো।
তামাক কোম্পানির প্রচারণা ও করোনা আবহে ধূমপান নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা সোশ্যাল মিডিয়ায়সহ অন্যান্য মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ধূমপান নিয়ে সেইসব ভুল ধারণা আমল দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। পরিমিত ধূমপান নয়, ধূমপান ত্যাগের পরামর্শই দিচ্ছেন পালমনোলজিস্টরা। ধূমপান ত্যাগকরলে ধীরে ধীরে শ্বাসতন্ত্র বা রেসপিরেটরি কার্যক্ষমতার উন্নয়ন ঘটবে এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা সহজ হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা হবে বলে অঙ্গীকার করেছেন। তিনি আইনের সুফল পেতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরী বলেও বিভিন্ন সময় বলেছেন। তাই সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় তামাক জনিত ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর হার কমানোর জন্য যে কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা জরুরী।
এক্ষেত্রে আমরা সাধারণ ভাবে যা দেখি তাহলো তামাক কোম্পানিগুলো অনেক সময় নীতিনির্ধারকদের আনুকল্য পেয়ে আসছে। যা সুস্পষ্ট ভাবে আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলছে। একদিকে তামাক কোম্পানির বেপরোয়া মনোভাব, তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা, নারী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য বিশেষ কর্মকৌশল না থাকা এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ জাতীয় নীতি প্রণয়ন না করা ইত্যাদি বিষয় গুলো তামাকের কার্যকর নিয়ন্ত্রণকে ব্যাহত করেছে।
বর্তমানে মহামারিকালীন সময়েও তামাক কোম্পানিগুলো নানা কৌশলে ক্ষতিকর তামাকের ব্যবসা স¤প্রসারণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। লকডাউনের মত অবস্থায় যেখানে সমস্তু অফিস আদলত, কল-কারখানা বন্ধ, অর্থনীতির চাকা অচল সে অবস্থাতেও তামাক কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ও বিপণন অব্যহত রেখেছে এবং তাদের এই আনুকুল্য প্রদান করেছে কিছু সংখ্যক নীতিনির্ধারক। যা সরকারের জনস্বাস্থ্য নীতির বিপরিতে অবস্থান এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্তরায়। তামাক কোম্পানিগুলো করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়কালে বিশেষ অনুমতি সংগ্রহ করে উৎপাদন চালু রেখেছে এবং নিজেদের কর্মচারী এবং তামাক শ্রমিকদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। করোনাকালীন সতর্কতার কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বতসোয়ানা তামাকজাতদ্রব্য বিক্রয়ের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর তামাকের নেতিবাচক প্রভাবের কথা বিবেচনা করে বিদ্যমান আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এবং সকল পর্যায়ে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপে বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। বিশ্ব নেতারা এই মুহুর্তে অর্থনীতির চেয়ে মানুষের জীবন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় পৃথিবীর বহু দেশ এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যকে বেশি গুরুত্ব¡ দিচ্ছে। অর্থনীতির বিবেচনায় যাই হোক, এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। তাই মহামারির এই পরিস্থিতিতে তামাক কোম্পানিগুলো উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে সরকারের দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।
লেখক:
পরিচালক, স্বাস্থ্য সেক্টর
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।