বুধবার সংসদে তিনি বলেন, “আমরা একদিকে যেমন করোনা মোকাবেলা করব পাশাপাশি দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন যাতে চলে, মানুষ যেন কষ্ট না পায়- তার জন্য যা যা করণীয় আমি করে যাব।”
জাতীয় সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্বের অনেক দেশ সংসদে বাজেট দিতে না পারলেও বাংলাদেশ তা দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
নিজের জীবন নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জন্ম যখন হয়েছে মরতেই হবে। তাই গুলি খেয়ে মরি, বোমা খেয়ে মরি, করোনাভাইরাসে মরি, অসুস্থ হয়ে মরি- এখন কথা বলতে বলতেও মরে যেতে পারি। মৃত্যু যখন অবধারিত তখন মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি ভয় কখনও পাইনি, পাব না। আল্লাহ জীবন দিয়েছে জীবন আল্লাহ একদিন নিয়ে যাবে- এটাই আমি বিশ্বাস করি।
“মানুষকে কিছু কাজ দেয়, সেই কাজটুকু করতে হবে। আল্লাহ আমার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, যতক্ষণ এই কাজটুকু শেষ না হবে ততক্ষণ কাজ করে যাব। কাজ শেষে আমিও চলে যাব। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমি এখানে বেঁচে থাকার জন্য আসিনি, জীবনটা বাংলারমানুষের জন্য বিলিয়ে দিতে এসেছি। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয়ের কী আছে?”
করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছুতে একটা অচলাবস্থা চলছে। পাশাপাশি মৃত্যু এসে হানা দিচ্ছে। অবশ্য এখানে সুস্থতার সংখ্যা অনেক বেশি। তারপরেও মানুষের ভেতর কেমন একটা আতঙ্ক বিরাজমান।
“বিশ্বের যে যতই শক্তিধর হোক, যতই অর্থশালী হোক, অস্ত্রের শক্তিশালী হোক- কোনো শক্তি কাজে লাগছে না। মনে হচ্ছে করোনাভাইরাসটাই সবচেয়ে শক্তিশালী। আর প্রকৃতি যেন তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। এমন একটা বিষয় আমার কাছে মনে হয়।”
করোনাভাইরাসে অনেকের মৃত্যু হওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের প্রশাসন যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, আনসার ভিডিপি, বিজিবি, সাংবাদিক প্রত্যেকে প্রতিনিয়ত জনগণের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সকলে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।”
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী যে অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে একটা দূরত্ব নিয়ে এসেছে। তবে এটা ঠিক সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়াতে পরিবারের সঙ্গে থাকার একটা সুযোগ করে দিয়েছে। জানি না সব জিনিসের ভালো-মন্দ দিক থাকে।”
এই মহামারীতে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা ছোটখাটো কাজ করত, দিন আনে দিন খায় তারা প্রত্যেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের খবর নিয়ে তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানো, এজন্য নগদ টাকার ব্যবস্থা করা। এতিমখানা মসজিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক তাদেরকে আমার ত্রাণ তহবিল, যাকাতের টাকাসহ নানাভাবে সহায়তা করেছি।
“আমরা মানুষকে খুঁজে খুঁজে বের করে সাহায্যটা দিয়েছি। সমাজের অগোচরে থেকে যাওয়া বিশাল জনগোষ্ঠীর কষ্ট দুঃখটা যাতে একটু লাঘব করা যায়, সেই চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছি।”
প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের কাছে আলাদাভাবে তহবিল পাঠানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একটা মানুষও যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়। প্রত্যেককে যেন সহযোগিতা করা হয়।”
এই সংকটে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দলের নেতাকর্মীরা যে যতটুকু পেয়েছে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিত্তশালীরা সাহায্য করেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সাহায্য করেছে।
“দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, করোনাভাইরাসে মারা গেলে আত্মীয়-স্বজন আপনজন ফেলে চলে যায়। সেই লাশ টানে পুলিশ বাহিনী। তারা নিয়ে কবর দিচ্ছে। জানাজা পড়ছে। সেখানে ভয়ে কোনো আপনজন থাকছে না। মানুষের মৃত্যুর পর এ ধরনের অমানবিক আচরণ করবে- এটা খুবই দুঃখজনক।”
বোরো মৌসুমে ধান কাটতে কৃষকদের ছাত্রলীগের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
“যেখানে আপনজনের লাশ ফেলে যায়, সেখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ মানবিকতা দেখিয়েছে এতেই আমি আশাবাদী,” বলেন শেখ হাসিনা।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “একদিকে করোনাভাইরাস অপরদিকে এলো ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমরা ২৪ লাখ মানুষকে শেল্টারে নিয়ে আসি। গৃহপালিত পশুপাখি আমরা শেল্টারে নেওয়ার ব্যবস্থা করি। প্রত্যেকের খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিই। এসবই করা হয় করোনাভাইরাসের নিয়ম মেনে। আম্পানে হয়ত অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে আমরা জান বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি।”
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের যে সকল বুদ্ধিজীবী বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। আমি প্রধানমন্ত্রী হই আর যা-ই হই শিক্ষক শিক্ষকই। তাকে আমি সব সময় শিক্ষকের মর্যাদাই দিয়ে এসেছি। তিনি অসুস্থ হওয়ার পর আমি চেষ্টা করেছি, সব সময় খোঁজ খবর নিয়েছি। চিকিৎসার সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। কিন্তু… বয়স পার হয়ে গিয়েছিল। পরিচিত মানুষ আজ হারিয়ে গেছে, সত্যি কষ্ট হয় আজ কাকে রেখে কার কথা বলব।”
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই সময় ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান পটলকেও হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিল।”
শোক প্রস্তাবের ওপর আরও বক্তব্য রাখেন আ স ম ফিরোজ, হাসানুল হক ইনু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, মতিয়া চৌধুরী ও বিরোধী দলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ।
পরে সংসদে তোলা শোক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সময় মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করে এক মিনিট নীরাবতা পালন ও মোনাজাত করা হয়।
শেষে রেওয়াজ অনুযায়ী স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত সংসদের বৈঠক মুলতবি ঘোষণা করেন।