সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মহামারি জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলেছে এবং এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।ইবোলা ও নিপাহ, সার্স, মার্স ও কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবগুলি অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায়ই জনস্বাস্থ্যের হুমকির মধ্যদিয়ে মানুষের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরেছে।
কোভিড-১৯ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে।পৃথিবীতে মানুষ খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে অসংখ্যবার মহামারির মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক মহামারিও হয়েছে কয়েকবার। এ সময়ের চেয়ে অনেক কম বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল তখন। প্রতিষেধক বা চিকিৎসাও তেমন পায়নি আক্রান্ত মানুষ।তবে অনেক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্য সচেতন ও সতর্ক থেকেছে। এভাবে একটি বর্ম তৈরি করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে মানুষ। আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বেও এই ভারতবর্ষে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লয়েঞ্জা, গুটিবসন্তসহ ভয়ঙ্কর কিছু মহামারি হানা দিয়েছিল।দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কেড়েছিল বহু মানুষের প্রাণ।
শতবছর পূর্বেও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও সমাজহিতৈষী খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ও মাহামারিকালীন স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতেও বিষয়গুলো সমভাবে গুরুত্ব রাখে।
মিশন প্রতিষ্ঠাতা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর বহুমুখী বর্ণময় জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা বেশ দূরহ বিষয়।স্রষ্টার সৃষ্টির অর্থাৎ মানবসেবার এমন কোন বিষয় নেই যা তার চিন্তা ও কর্মজীবনকে স্পর্শ করেনি।বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার কর্ম জীবন থেকে অনেক কিছু তুলে আনার চেষ্টা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। যুগের প্রয়োজনে তার অনুসারীগণ তাকে নতুনভাবে আবিষ্কারের প্রয়াস পায়। তার চিন্তা ও কাজকে বিশ্লেষণ করে যুগের প্রয়োজনীয়তাকে মিটানোর চেষ্টা করা হয়। শতবছর আগে তার মানবিকতা বোধ ও স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি মানুষের কর্তব্য নিয়ে তার ভাবনা আজও প্রাসঙ্গিক।সম্প্রতি মহামারি ও জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয়ে আমাদের অতীতকে বিশ্লেষণ করার জন্য প্রভাবিত করেছে।
মিশন প্রতিষ্ঠাতার জন্ম ও বেড়ে উঠা এই উপমহাদেশের এক যুগসন্ধিক্ষণে।একদিকে বৃটিশদের কলোনীয়াল শাসন অন্যদিকে তা থেকে ভারতবাসীর মুক্তির আকাঙ্খা। ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনকালীন সময়ে, বঙ্গবাসী বিশেষ করে মুসলিম সমাজসহ নিম্নবর্ণের দরিদ্র জনগোষ্ঠী পিছিয়ে ছিল স্বাস্থ্যসেবা, আধুনিক শিক্ষা, উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং মুক্ত চিন্তা থেকে। এরকমই এক প্রেক্ষাপটে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর বেড়ে ওঠা, যা তার সামগ্রিক কর্মময় জীবন এবং চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল।
আমরা খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর লেখনী ও সৃষ্টির সেবার জন্য তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও কাজকে যদি পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই তৎকালীন ভারতবর্ষে স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা তাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তিনি বিভিন্ন ভাবে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালে তার লেখা ‘মানবের পরম শত্রু’ বইয়ে মহামারি, জনস্বাস্থ্য এবং ভারতবর্ষের দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র পাই।
যক্ষ্মা (ক্ষয়) রোগ সম্পর্কিত এই বই এর পটভূমিতে তিনি লিখেছিলেন ‘পাঠকবর্গের অবগতির জন্য মানবের পরম শত্রু নাম দিয়া পুস্তককারে লিপিবদ্ধ করিলাম। ইহার দ্বারা একটি আত্মারও উপকার সাধিত হইলে পরিশ্রম সার্থক মনে করিব। ক্ষয়রোগ সম্বন্ধে সাধারণের জ্ঞান অতি সীমাবদ্ধ। বিশেষত; উপরোক্ত স্বাস্থ্যনিবাস সম্বন্ধে অনেকেই কোন খবর রাখেন না। আশা করি, ইহার দ্বারা তাহাদের অভাব কিয়ৎ পরিমাণে দূরীভূত হইবে।’
তৎকালীন সময়ে ভারতসহ বিশ্ব জুড়ে যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুবরণ করত। এছাড়াও তার লেখা টিচার্স ম্যানুয়েল, ভক্তের পত্র, আমার শিক্ষা ও দীক্ষা, আমার জীবন ধারাসহ বিভিন্ন বইয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক অনেক বিশ্লেষণ ও করনীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘যে পর্যন্ত জীবাণু দেহান্তর্গত না হয়, সে পর্যন্ত কোন আশঙ্কার কারণ হয় না। আবার যাহাদের জীবনীশক্তি যত প্রবল, তাহারা তত সহজে জীবাণুর ক্ষমতা রোধ করিতে পারে। যাহারা পূর্ব হইতে ম্যালেরিয়া, কলেরা, রক্ত আমাশয় প্রভৃতি রোগে শীর্ণ হইয়াছে এবং যাহাদের প্রতিরোধ-শক্তি হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়াছে, সেই সকল লোকের পক্ষে আশঙ্কা।’ তিনি সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিষয়ে কথা বলেছেন ও সঠিক জীবন চর্চা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধ পানি পান ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধকে উৎসাহিত করেছেন।
১৮১৭ সালে শুরু হওয়া কলেরা মহামারি ১৮২৪ পর্যন্ত কম-বেশি এর দাপট নিয়ে অব্যাহত থাকে এরপর একই সময়ে না হলেও বিভিন্ন পর্যায়ে কলেরা বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়। কলেরায় বিশ্বে বহুদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ১৮১৭ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ভারতে কলেরা গ্রাস করে দেড় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ। ১৮৭৯ সালের আগে কলেরার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। ফলে খুব অসহায়ভাবেই মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ১৮১৭ সালের কলেরায় ঢাকায় প্রতিদিন দেড়শ থেকে দু’শ মানুষ মৃত্যুবরণ করত। তখন ঢাকায় উল্লেখ করার মতো কোনো হাসপাতালও ছিল না। সে সময় ঢাকার কালেক্টর স্যার রবার্ট মিটফোর্ডকে এর বাস্তবতা ব্যথিত করে। ১৮২৮ সালে তিনি দেশে ফিরে যান। মৃত্যুর আগে তার সম্পত্তি উইল করে যান যেন ঢাকায় একটা হাসপাতাল তৈরি হয়। মিটফোর্ড হাসপাতাল তৈরির ইতিহাস এখান থেকেই শুরু হয়।
এই কলেরা মহামারি প্রতিরোধে খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) তার মিশন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘মিশনের মধ্যে যে সকল যুবক আছেন, তাহারা কলেরার প্রার্দুভাব হইলে অলি-গলিতে উপস্থিত হইয়া দরূদ ও তকবীর ধ্বনী দ্বারা উৎপীড়িত স্থানকে মুখরিত করেন, স্বহস্তে মৃতদের দাফন-কাফন করেন, কলেমাখানির বন্দোবস্ত করেন ও স্থান বিশেষে মিলাদ শরীফের ব্যবস্থা করেন, তজ্জন্য কিছু দাবি করেন না।’
বাংলায় প্লেগ ও কলেরা ভয়াবহ মহামারি হিসেবে কয়েকবারই দেখা দিয়েছে। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আফগান সুলতানদের শাসন ছিল। এ সময় রাজধানী গৌড়ে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। প্লেগের ধরন অনেকটা করোনার মতোই। জ্বর, মাথাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি এবং ভীষণ ছোঁয়াচে। প্লেগের সঠিক চিকিৎসা তেমন না থাকায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়।
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্লেগে গড়ে প্রতিদিন এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যেত। এত শবদেহ দাফন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মরদেহ বিল-ঝিল আর ভাগীরথী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। আমরা দেখেছি বর্তমান করোনা মহামারিতে মৃতদেহের সৎকার নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখেছি কোভিড-১৯ আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে তাই সেই মৃতদেহ সৎকারেও অনেকের অনিহা। সাধারণ ধর্মীয় রীতি মেনেই কোভিড-১৯ মৃতদের দেহ সৎকার সম্ভব। কিন্তু মানুষের অজ্ঞতা, ভুল প্রচারণা, সামাজিক স্টিগমার কারণে সন্তান বাবা-মা এর মৃতদেহও সৎকার তো দূরে থাক অনেকে হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ গ্রহণ করতেও অস্বীকার করেছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কিভাবে স্বাভাবিক উপায়ে করোনায় আক্রান্তদের আত্মীয়-স্বজন না হয়েও মৃত্যুবরণকারীদের মৃতদেহ সৎকার করছেন এবং স্বজনদের সাহায্য করছে।
এ বিষয়ে খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর বিভিন্ন বই ও লেখনীর মাধ্যমে জানতে পারি কলেরা মহামারির সময় মিশনের সদস্যগণ কিভাবে মানুষের পাশে থেকে মৃতদেহ সৎকারে সাহায্য করেছিল। তিনি আমার জীবন-ধারা বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘মিশনে অনেকে উপস্থিত হইয়া মৃতপ্রায় প্রাণে নূতন প্রেরণা উদ্দীপ্ত করিত ও দরুদ পার্টির আয়োজন করিয়া রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত। ইহাতে খোদার ফজলে কলেরা প্রশমিত হইত, লোকের মনে নুতন বলের সঞ্চার হইত। মিঞা মজনু স্বয়ং কাফনের কাপড় সেলাই করিতেন, গোছল ও জানাজার ব্যবস্থা করিতেন। কিন্তু কাহারও নিকট হইতে পয়সা কড়ি লইতেন না। ইহার ফলে মিশন শক্তিশালী হইয়া উঠিল। নূতন নূতন মেম্বর লিস্ট ভুক্ত হইতে থাকিল।’ তিনি যে উদ্দেশ্যে মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই কাজের মধ্য দিয়ে যথার্থতা প্রমাণ করে।
অতীতে মানুষ বিভাবে বিশ্ব মহামারি মোকাবিলা করেছে, মহামারি পরবর্তী বিশ্বই বা কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল তা আমরা জানি। ভারতবর্ষে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল এই মহামারিকে ঘিরে। শত বছর ধরে ভারতবর্ষে চরক ও শশ্রুতা (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০-৫০০) মতে স্বাস্থ্য সেবা প্রচলন ছিল। এই চিকিৎসা সেবা মূলত আয়ুর্বেদ চিকিৎসাভিত্তিক ছিল। এর বাইরে আমরা দেখেছি ধর্মীয় বিধি-বিধান মোতাবেক দোয়া-দুরূদ, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ, পূজা-প্রার্থনা ইত্যাদির প্রচলন ছিল।
১৮৯৬ এর প্রথমদিকে বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। দ্রুত মহামারি আকারে কলকাতা ও আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। কলকাতা শহরে প্লেগ রোগীদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল তৈরি করা হয়। ইংল্যান্ড থেকে অনেক ডাক্তার নিয়ে আসা হয়। এখানেও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা কাজ করে। মুসলমানরা দাবি করে, তাদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতাল করার টাকা তারাই দেবে। মাড়োয়ারিরা নিজেদের জন্য আলাদা হাসপাতাল তৈরি করে কলকাতায়। আমরা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ক্ষেত্রে দেখেছি তিনি যেমন আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্তা রেখে মহামারিকালীন ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করেছেন তেমনিভাবে আধুনিক চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্র, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন ও নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি মিশন প্রতিষ্ঠার দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ ও দেবহাটার মধ্যবর্তী স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের আবশ্যকতার কথা তুলে ধরেন।
তিনি গর্ভবতী মায়ের জন্য নিরাপদ মাতৃত্বের কথা বলেছেন, পাশাপাশি দক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে নিরাপদভাবে শিশু জন্ম দেওয়ার কথাও বলেছেন। এবং মিশনের কার্যপরিধিতে ধাত্রী প্রশিক্ষণকে সম্পৃক্ত করেছেন।
রোগীদের চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা ও অচ্যুতনাথ অধিকারী রচিত টিচার্স ম্যানুয়েলে (প্রকাশকাল-আগস্ট ১৯১৫) রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক অনেক দিক-নির্দেশনা আমরা খুঁজে পাই। টিচার্স ম্যানুয়েলে একাদশ অধ্যায়ে ছাত্রদের স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষার ও নিয়ন্ত্রিত জীবনাচারের কথা বলা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য মানুষের সর্ব্ববিধ সুখের মূল। শরীর অসুস্থ হইলে মানব সর্ব্বপ্রকার কার্য্যরে অযোগ্য হইয়া পড়ে। সুতরাং বাল্যকাল হইতেই সকলের স্বীয় স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা কর্ত্তব্য। শরীর এবং মনকে স্বাস্থ্যবান রাখিতে হইলে আহার্য্য, পরিধেয়, পরিচ্ছন্নতা, ব্যায়াম এবং বিশ্রাম সম্বন্ধে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’
তিনি অনুধাবন করেছিলেন শিশুদের সঠিক জীবনাচার শেখাতে পারলে অনেক রোগের প্রতিরোধ সম্ভব। ছাত্রদের প্রত্যাহিক জীবনের যে শৃঙ্খলা তা শেখনোর জন্য যেমন বাবা-মা তেমন শিক্ষকের দায়িত্বে কথা তুলে ধরেছেন। আমরা বর্তমানে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শেখানোর জন্য হাইজিন প্রমোশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকি। সেই শত বছর পূর্বেও তার লেখনিতে আমরা তার বীজ নিহিত আছে বলে মনে করি।
‘পরিচ্ছন্নতা শরীর এবং মন উভয়েরই পবিত্রতা সাধন করে। বাল্য হইতে ইহা অভ্যাস না করিলে পরিণত বয়সে আয়ত্ত করা দুঃসাধ্য হইয়া পড়ে। মুখ, দাঁত, গ্রীবা, মস্তক, হাত, নখ, চুল সর্ব্বদা মলমর্জ্জিত রাখিতে হইবে। পরিধেয় বস্ত্রের ন্যায় জুতাও প্রত্যহ পরিষ্কৃত করা প্রয়োজন। শরীরের ময়লা দূরীকরণের জন্য স্নানাভ্যাস করিতে হইবে।’
তিনি বুঝে ছিলেন শিশু-কিশোরদের সঠিক জীবন চর্চার মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠন সম্ভব।
তিনি মানবের পরম শত্রু বই এ স্কুল ভিক্তিক স্বাস্থ্য পরিচর্যারকথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘প্রত্যেক বৎসর প্রত্যেক বিদ্যালয়ে উপযুক্ত ডাক্তার কর্ত্তৃক ছাত্র ও ছাত্রীদিগের পরীক্ষা করা অত্যাবশ্যক। যে সকল শিক্ষক ব্যায়াম ও ছাত্রনিবাস তত্ত্বাবধান করেন, তাঁহাদিগকে স্বাস্থ্যের বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলী ভালরূপ জানিয়া রাখা উচিত। কোন ছাত্রের কোন রোগ দেখিলে, তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যে-নিবাসে পাঠাইবার বন্দোবস্ত করা বিধেয়।’ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর এই জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নির্দেশনা বর্তমান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জনস্বাস্থ্য ভাবনার সীমা আজো অতিক্রম করতে পারেনি।
আমরা আজ মহামারিকালীন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা জোরেশোরে বলছি। শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মনের স্বাস্থ্যেরও যে পরিচর্যা প্রয়োজন তাও তিনি অনুধাবন করেছিলেন। টিচার্স ম্যানুয়েলে তিনি শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যকে সমভাবে গুরুত্বের সাথে বিবেচনার কথা বলেছেন, ‘প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শারীরিক ও মানসিক শিক্ষার বন্দোবস্ত থাকা আবশ্যক। শারীরিক শিক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত-(১) স্বাস্থ্যনীতি (২) ব্যায়াম। কোন কোন বিদ্যালয়ে ব্যায়ামের ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নাই। স্বাস্থ্যের সহিত মানসিক শিক্ষার বিশেষ নিকট সম্বন্ধ। কি উপায় অবলম্বন করিলে ছাত্রগণ সুস্থ থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিতে পারে প্রত্যেক শিক্ষকের তাহা জানা উচিত।’
সংক্রামক রোগের মহামারির ইতিহাসও অনেক প্রাচীন তেমনি অসংক্রামক রোগ যুগ যুগ ধরে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আজ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সংক্রামক রোগ নিয়ে মানুষ যেমন চিন্তিত তেমনি অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দিনদিন বেড়ে চলেছে। এদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এদেশে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণের সাথে তামাক সেবন ও ধূমপানকে দায়ী করে থাকেন। টিচার্স ম্যানুয়েলে আমরা দেখেছি ধূমপানে বিভিন্ন ক্ষতির কথা বলেছেন এবং এবিষয়েও ছাত্রদের শিক্ষা দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
বিশ্বে কোন রোগ বা মহামারি শুধু এক শ্রেণির পেশাজীবী দ্বারা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের মহামারি মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। কোন মহামারিই রাতারাতি শেষ হয়নি। দুই-তিন বছর, এমনকী একাধিকবার আঘাতসহ যুগ যুগ ধরে চলেছে এর প্রকোপ।
কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের ধরন ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে সহজেই অনুমেয় যে এটিও রাতারাতি শেষ হবে না। তাই, প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই দীর্ঘমেয়াদী মহামারি মোকাবিলা পরিকল্পনা প্রয়োজন। এজন্য খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) দেখানো পথ অনুকরণীয় হতে পারে। অর্থাৎ আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষার সাথে সুস্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির শিক্ষা দিতে হবে। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ধর্মীয় বিধি-বিধান ও বিশুদ্ধ জীবনাচার পালনের মাধ্যমে কীভাবে জীবন গঠন করতে হয় তার পথ তিনি দেখিয়ে গেছেন। পাশাপাশি রোগাক্রান্ত মানুষের সেবা ও তাদের সুচিকিৎসার জন্য তার যে ভাবনা তা আজও ফুরিয়ে যায়নি। তার প্রতিষ্ঠিত আহ্ছানিয়া মিশন তারই ভাবাদর্শকে ধারণ করে আজও মানুষের সেবা করে যাচ্ছে। যে অনুপ্রেরণা ও উদাহরণ তিনি তার কর্মে ও লেখনীতে রেখে গেছেন তা অম্লান। কোভিড-১৯ আজ আমাদের নৈতিকতা ও মানবিকতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অগ্রগতি ও আধুনিকতার অহংকারকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে।
রোগাক্রান্ত মানুষকে বিনা চিকিৎসায় রাস্তায় মরতে হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মীরা আত্মীকেন্দ্রীকতার চূড়াকে স্পর্শ করেছে। মানুষ শুধু নিজে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। আজ যদি আমরা ইসলামসহ যেকোন ধর্মের মর্মার্থ বুঝতে পারতাম, মানুষের সেবার নূন্যতম ভাবনা আমাদের থাকত, তাহলে এই ক্রান্তিকালকে পরাজিত করা মানুষের জন্য তেমন কিছুই না। সংক্রামক রোগের মহামারির বিস্তার মোকাবিলা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মানবতা বোধের ও সেবার ব্রত থাকতে হবে।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) যেভাবে স্বাস্থ্যে সেবার গুরুত্বের কথা বলেছেন তা আজও জাতীয় ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যই জাতীয় শক্তির ভিত্তি-স্বাস্থ্যের ওপর জাতীয় শক্তির ভিত্তি স্থাপিত। যে জাতি দূর্ব্বল ও নিস্তেজ, সে জাতি কদাপি উন্নতির শীর্ষস্থান লাভ করিতে সমর্থ হয় না। জন সাধারণের সুখসমৃদ্ধি, তাহাদের স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে।’ আমরা আজও এই কথার মর্মার্থ অনুধাবন করে সঠিক স্বাস্থ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হইনি।
পরিশেষে বলতে চাই, পৃথিবীতে সকল মহামারিই একে একে শেষ হয়েছে। কোভিড-১৯-ও একদিন শেষ হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ মানুষ ও মানবিকতার মাঝে যে ব্যবধানের দাগ টেনে দিয়ে যাবে তা মুছতে আধুনিক বিজ্ঞান ও মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে যেমন কাজে লাগাতে হবে তেমনি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর দেখানো পথ ‘স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টের সেবার’ মাঝে অনেক পথ নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব। যা এই সংকটকালে আলোকবর্তিকা হয়ে জাতীর সামনে আসতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১। আমার জীবন-ধারা
২। আমার শিক্ষা ও দীক্ষা
৩। টিচার্স ম্যানুয়েল
৪। মানবের পরম শত্রু
লেখক: পরিচালক, স্বাস্থ্য এবং ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন