লিয়াকত রাজশাহী : রাজশাহী মহানগরীর ছাত্রলীগ নেতা শাহিন আলম ওরফে শাহিন শাহ হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির যুক্তিতর্ক চলছে। দীর্ঘ সময় পর মামলার কার্যক্রম শুরু হওয়ায় আসামিদের শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত হবে বলে প্রত্যাশা করছেন নিহত শাহিন শাহর পরিবারের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৩০ জুন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে এক নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে অংশ নেন নিহত শাহিন শাহর বড় ভাই রজব আলী। ঐ নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রাজশাহী মহানগর বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মনসুর রহমান। নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় মনসুরের বিরুদ্ধে রাজশাহী নির্বাচন অফিসে অভিযোগ করেন শাহিন শাহ এবং তার ভাই রজব আলী।
এছাড়া রাজশাহী অঞ্চলের মাদকজোন হিসেবে খ্যাত রাজশাহী মহানগরীর গুড়িপাড়ায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক মনসুরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগ নেতা রজব এবং তার পরিবারের সদস্যরা। এসব ঘটনায় ক্ষিপ্ত হন মনসুর। তিনি প্রকাশ্যে রজব এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনার জের ধরে ২০১৩ সালের ২৭ আগস্ট মনসুর এবং তার ক্যাডার বাহিনী রজবের বাড়ি এবং ব্যবসায়িক কার্যালয়ে হামলা চালান। হামলায় রজবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দুইজন ব্যবস্থাপক গুরুতর আহত হন।
পরের দিন ২৮ আগস্ট দুপুর ১২টায় মনসুর রহমান আবারও তার সহযোগী বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের সাথে নিয়ে দেশীয় ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নগরীর গুড়িপাড়া এলাকায় শাহিন শাহর ওপর পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র হামলা চালায়। ফলে ঘটনাস্থলেই নৃশংসভাবে খুন হন রাজশাহী কোর্ট কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহিন শাহ।
এ ঘটনায় শাহিন শাহর ছোট ভাই রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদ আক্তার নাহান পরের দিন ২৯ আগস্ট মনসুরসহ বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের বিরুদ্ধে নগরীর রাজপাড়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় রাজপাড়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএম রেজাউল ইসলাম মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে উপ-পরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেন।
এরপর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটির কার্যক্রম শুরু হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঐ আদালতে ৩১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ট্রাইব্যুনালে চার্জ গঠন হয়। ১৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দিও গ্রহণ করা হয়।
কিন্তু সাফাই সাক্ষীর নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার নিষ্পত্তি ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। প্রয়োজনবোধে আরও ৪৫ দিন অতিরিক্ত সময় দিতে পারেন ট্রাইব্যনালের বিচারক। কিন্তু দফায় দফায় সাফাই সাক্ষীর অজুহাতে মামলাটির মেয়াদ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে শেষ হয়ে যায়।
এরপর নিয়মানুযায়ী রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মামলাটি স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে মামলাটির রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের পরই মামলাটির রায় ঘোষণা হবে বলে জানিয়েছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এহসান আহমেদ শাহীন।
তিনি বলেন, মামলায় আসামির সংখ্যা ৩১ জন। মামলাটির রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বুধবার পর্যন্ত টানা চার দিন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক চলল। আগামী ১৫ মার্চ আবারও যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। এরপর শুরু হবে আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হলে মামলটির রায় ঘোষণার দিন ধার্য্য করবেন আদালত।
নিহত শাহিন শাহর বড় ভাই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বর্তমান প্যানেল মেয়র-২ রজব আলী বলেন, আমাদের পরিবারের নেতৃত্বে রাজশাহী মহানগরীর পশ্চিমাঞ্চলে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। এ কারণে বিএনপি নেতা মনসুর ক্ষিপ্ত ছিলেন। এছাড়া আমাদের পরিবারের সদস্যরা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। এ কারণে তারা আমার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে খুন করে।
মামলার এক নম্বর আসামি মনসুর রহমান রাজশাহী মহানগর বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলারও চার্জশিটভুক্ত আসামি। মামলাটি বর্তমানে আদালতে চলমান। এছাড়া মনসুরের বিরুদ্ধে রয়েছে পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মামলা। আরেক আসামি হাসান নগর যুবদলের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক। হাসানের আরেক সহযোগী বিএনপি কর্মী টিয়া আলমও মাদক মামলার আসামি। এরা দুজনেই বর্তমানে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। মামলার আরেক আসামি সাইরুল সদ্যগঠিত কাশিয়াডাঙা থানা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক। তিনি আদালতে বোমা হামলা মামলার এক নম্বর আসামি। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতার মামলা। সাইরুলের চাচাত ভাই মাসুদ জামায়াতের ক্যাডার। মামলার অপর আসামিরাও বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে।
নিহত শাহিন শাহর ছোট ভাই যুবলীগ নেতা নাহিদ আক্তার নাহান বলেন, মনসুরের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা আমার ভাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করেছে। দীর্ঘ সাতবছর থেকে আমরা আদালতে ঘুরছি। মামলাটির যুক্তিতর্ক চলছে। আশায় বুক বেধেছি। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ন্যায় বিচারের মাধ্যমে আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।