গাজীপুর সিটির মেয়র নির্বাচিত হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম। জাতীয় নির্বাচনের ৬ মাস আগে অনুষ্ঠিত এই সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীককে বেছে নিলেন নগরবাসী। নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত গতবারের নির্বাচনে হারলেও এবার দলীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বড় ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীকে পরাজিত করেছে।
৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে গতকাল রাত পৌন ২টা পর্যন্ত অসমর্থিতসূত্রে সর্বশেষপ্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ৩৪৫টি কেন্দ্রের ফলাফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম নৌকা প্রতীকে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯৪ ভোট পেয়েছেন। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৫৫ভোট। ব্যালট পেপার ছিনতাই ও অনিয়মের কারণে ৯টি কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত রেখেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত ফলাফল না পাওয়া গেলেও নৌকা প্রতীক ধানের শীষের চেয়ে প্রায় দুই লাখের মতো ভোটে এগিয়ে আছে। অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলোর ফলে ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে বিজয়ী হওয়া এক প্রকার অসম্ভব বলে নিশ্চিত করেছে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়। ফলে জাহাঙ্গীরে জয় শতভাগ নিশ্চিত। রিটার্নিং অফিসার ঘোষিত ১৫৬ কেন্দ্রে নৌকা পেয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৪ ভোট। ধানের শীষ পেয়েছে ৭৩ হাজার ২২৯ ভোট।
মঙ্গলবার রাতে বঙ্গতাজ অডিটোরিয়ামে অবস্থিত অস্থায়ী কার্যালয় থেকে রিটার্নিং অফিসার রকিবউদ্দিন মন্ডল প্রতিটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন। আর বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঝে নেমে আসে হতাশা। ফলাফলের বিষয়ে এত তাত্ক্ষনিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ইত্তেফাককে বলেন, আমি গাজীপুরবাসীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমি যে অঙ্গীকার করেছিলাম তা জীবন দিয়ে হলেও বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। সিটি করপোরেশন সবার। আমি সবাইকে নিয়ে কাজ করবো।
অন্যদিকে, বিএনপির প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকার নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফল প্রত্যাখান করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় নিজবাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এই ফল জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি জনগণের সঙ্গে আছি।
যদিও গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে কিছু কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ৯টি কেন্দ্রে অনিয়ম-জালভোট ছাড়া বাকি ৪১৬টি কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ও উত্সবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে।
২০০৯ সালে গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে দুই লাখ ৯৭ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে জাহাঙ্গীর আলম তাক লাগান সবাইকে। তিনি আবারও আলোচনায় আসেন ২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনের আগে। দল আজমত উল্লাহ খানকে মনোনয়ন দিলেও নাছোড় জাহাঙ্গীর মেয়র পদে দাঁড়ান। নানা নাটকীয়তার পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও ৩১১৯ ভোট পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। পরবর্তীতে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্দলীয় নির্বাচনে বিএনপি জোট সমর্থিত অধ্যাপক আবদুল মান্নান টেলিভিশন প্রতীকে লড়াই করে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ভোট পেয়ে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। প্রতিদ্বন্দ্বি ১৪ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান ২ লাখ ৫৮ হাজার ভোট পান। ১ লাখ ৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীর বিজয়ী হয়েছিলেন। যদিও সেই নির্বাচনে বেশির ভাগ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
নির্বাচনে সাত মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ২৫৬ জন ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর পদে ৮৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মেয়র পদে অন্য প্রার্থীরা হলেন-ইসলামী ঐক্যজোটের ফজলুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. নাসির উদ্দিন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাজী মো. রুহুল আমিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ।
গাজীপুর সিটি করপোরেশ নির্বাচনে এবারের ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ জন ও নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন। এ সিটিতে এবার নতুন ভোটার এক লাখ ১১ হাজার। এছাড়া শ্রমিক ভোটার দুই লাখের বেশি। ৪২৫টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ৬টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারি প্রিজাইডিং এবং পোলিং অফিসার (ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৮ হাজার ৭০৮জন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন।
উচ্চ আদালতে যাবেন হাসান সরকার। হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির গাজীপুরের মেয়রপ্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগের দিন বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক না করতে হাইকোর্ট ও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে আমাদের নেতাকর্মীদের আটকসহ হয়রানি করা হয়েছে, এর প্রমাণ আমার কাছে আছে। এ নিয়ে আমি আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে উচ্চ আদালতে যাবো। কেন তারা হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে গ্রেফতার করেছে, এর একটা জবাব দিতে হবে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টঙ্গীর নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার সময় এসব কথা বলেন তিনি।