একুশের সবটুকু
কাজল চক্রবর্তী
……………………………………………………….
ধানসিঁড়ি মধুমতি পদ্মার ঢেউয়ে নেচে নেচে
একদিন আমাদের ভাষানিয়ে শহীদের লাল
মান্যকরে শতাব্দীর অন্ধকার দু’হাতে সরিয়ে
মূল্যবান আসবাবে মাতৃভাষা স্থাপন করেছি।
ভাষার এ জয় একান্তই আমাদের নিজস্ব অর্জন
বাঁকাচাঁদ তারমত বেঁচে থাক আনন্দ আকাশে
যতি-কমা-পূর্ণচ্ছেদ পদাবলী নিয়ে বেশ আছি
আমাদের একুশের সবটুকু আমাদের কাছে।
বাংলা আমার, ভাষা আমার
শান্তিময় মুখোপাধ্যায়
………………………………………
মুখর তোমার বর্ণমালায় দেখি
হঠাৎ কেমন দাঁড়ায় এসে
ভোরের দোয়েল পাখি
ম-এর পাশে আ-কে বসাই
মূর্তি গড়ি মা-র
ঘেরাটোপের নিষেধ ভেঙে
হাওয়া আসে,আজান ভাসে
ওপার থেকে ডাক দিয়েছেন
আমারই আম্মা
দিনের পাতায় যেদিন তোমার
অশ্রু ঝরায় চোখ
বাংলা আমার, ভাষা আমার
হয়েছো বীতশোক
ভাষাজ্বর
সৌমিত বসু
……………………………………..
তুমি আমার শেখানো অক্ষর
তুমি আমার অন্নপূর্ণা ভাষা
বরফঠোঁটে জানিয়েছিলাম তাকে
সম্বলহীন তুচ্ছ ভালোবাসা।
তুমি আমার জন্ম প্রতিবেশী
বুকে তোমার অনন্তরাত জাগে
স্বপ্নে যারা মরতে চেয়েছিলো
শহীদ হতে ছোটে আলোর আগে।
আমি তোমার ছাত্র হয়ে শিখি
মায়ের ভাষা আগলাতে হয় কেন।
বায়ান্নোর সন্তান
কামরুল বাহার আরিফ
শ্রদ্ধা : সৈয়দ শামসুল হক
………………………………………….
কালের খেয়ায় ভেসে এসে তীরে
বিজয়ের পতাকা উড়ালে তুমি
শীতপীড়িত এই অভিঘাতের দেশে।
‘বায়ান্নোর সন্তান’ গর্বে ধারণ করে
কবি আব্দুর রব মুনশী বেশে
তুমি জাগ্রত নূরলদিন অবশেষে।
‘সাদা পাহাড়ের মতো’ শান্ত শান্তিধারা
চিরায়ত প্রেম বুকে নিয়ে
এ অবক্ষয়ের শীতসঞ্চিত দেশে
জ্বালালে ওম- নাটক, গীত, কাব্যাংশে।
দৃঢ়তার স্বমহিমায় এবার রক্তধারায়
জ্বালালে আগুন দীপ্র মশালে
রক্তচক্ষু বা মৃত্যুভয় পরাভূত করে
শীত শীত ভয় জয় করে শেষে
ঢেলে দিলে লেলিহান অগ্নি-আগুন
কী ভীষণ ঘৃণার সাম্প্রদায়িক বিষে
‘বায়ান্নোর সন্তান’ বেশে।
ভাষার গান
তৌফিক জহুর
………………………………….
গ্রহণ লেগেছে প্রাচীন সূর্যে
অথচ ভাবো সেই সময়ের কথা
যখন মধ্যরাতে সূর্যের আলোয় ধরা পড়ে কালোপাহাড়
সকালের আজান কত দীপ্ত
পৃথিবী আঁধার করা ঝড় মুছে যায় আজানের ধ্বনি তরঙ্গে
প্রাতভ্রমণের মিছিল প্রবেশ করে অশ্বখুরে অগ্নিপোশাকে
থেমে যায়,থেমে যেতে থাকে পিশাচের হাসি
প্রতিটি বাড়ি পাড়া মহল্লায় বেজে ওঠে ভাষার গান
রহস্যের ফাঁক -ফোকর দিয়ে বালক বংশধর
রঙতুলিতে এঁকে চলেছি পিতৃপুরুষের অর্জিত পিরামিড।
মা,মায়ের জন্য একদা যে লড়াই
তা আজো চলেছে সাঁওতাল পল্লী থেকে
প্রাসাদের চূড়ায়।
মিছিল কখনো শেষ হয়না-
মনে রেখো অ আ ক খ থাকবে
দৃষ্টি এখন সু-উচ্চ আকাশ ছাড়িয়ে আরও দিগন্তে প্রসারিত।
অগ্রন্থিত
তৃষ্ণা বসাক
………………………………………………………..
ইট লাল ভেলভেট এও কি নতুন কোনো বই
মরা গাছ, কাঁদবে না,আমি ফের ফুল ফোটাবই
ঝরাপাতা জড়ো করে আগুন তো জ্বালা যেতে পারে
ওম ভাগ করে নেব,তাই তো এসেছি পাঠাগারে
নাম লিখে বসে আছি,খুঁজতে খুঁজতে বয়ে যায় বেলা
বেশিরভাগ চেনা বই,তারপর এসেছি একেলা
লাইব্রেরি দয়া করো,আমি চাই অমৃতের স্বাদ
একবিন্দু পেলে ঘোচে সমস্ত জন্মের অবসাদ
আবার না হয় আমি হরফহীন কোনো ভাষা
পরাগসংযোগজাত অগ্রন্থিত,শ্রবণ পিপাসা।
আমি বাংলাদেশের লোক
কুশল ভৌমিক
………………………………………………………..
চেয়ে দেখো,ফাগুনের ডালে ডালে ফুল হয়ে
ঝুলে আছে-আমাদের বর্ণমালা।
মৌরঙা ফুল খোপায় গুজে গুজে বিষণ্ণ বাসন্তী
গোটা জীবন তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে
অভাবনীয় শব্দের আদরে ভরিয়ে দিচ্ছি
জীবনের সবকটি সাদা পৃষ্ঠা।
আরশিতে হেসে ওঠা আমাদের আনন্দ,
বারোয়ারি জীবনের বিপন্ন বেদনা
মোহ মায়া প্রেম প্রাচুর্য
আমাদের জল্পনা কল্পনা
ভুল ভ্রান্তি প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির দোদুল দোলনা
শানিত শপথ প্রাণিত প্রতিজ্ঞা
এক থেকে বহু হবার দৃপ্ত প্রেরণা
সব -সব সুগন্ধ বুকে নিয়ে
দেখো, ফুল হয়ে ফুটে আছে
আমাদের বর্ণমালা।
আমাদের প্রতিটি অক্ষর পাখি
প্রতিটি শব্দ বিমূর্ত ওঙ্কার
চর্যার সিঁড়ি ভেঙে আমদের বর্ণমালা পোঁছে যায়
তোমাদের উত্তরাধুনিক দরোজায়
শুক সারি ব্যাঙমা ব্যাঙমী
ঠোঁটে ঠোঁটে জানিয়ে দেয় আমার পরিচয়…
আমার ভাষা তোমার ভাষা ভালোবাসা হোক
আমি ভাষার জন্য জীবন দেয়া বাংলাদেশের লোক।
আদিঅক্ষরের যাত্রা
স্নিগ্ধা বাউল
……………………………………………………….
প্রিয় ঘাসফুল, নরম রোদের দিকে তাকিয়ে
তুমি যে গল্প বলে যাও,
প্রেমের দ্রোহের কিংবা প্রতিধ্বনির –
সে ফুল আমায় বলে যায় – বাহান্নকাল
প্রিয় রাজপথ, পিচঢালা পথের আকাশে
রোদের মিছিলে যে পথচলা
সে পথ আমায় দেখায় স্বপ্নের পটচিত্র
আমি তারে ইতিহাস বলি;
প্রিয় পাঠ্যপুস্তক, পাতায় পাতায় যে অক্ষর
আমাদের স্নায়ু করোটির নিমজ্জনে
লিপির পরিবাহে প্রবাহিত
জাতিসত্তার অনন্তকাল, আরেক ফাল্গুন
সমস্ত আমাকে নিয়ে যায় প্রপিতামহে;
প্রিয় মানচিত্র, রক্তের দাগ শুকিয়ে যে সীমানা
দাবদাহের খাণ্ডব; চরাচরের অনন্ত প্রবাহ
বন বিচালির হাওয়ার কোলাহল
আমাকে জানায় শীতল অভিবাদন
লাঙ্গলের ফলায় জমিনে তুলে আনে আদ্যাক্ষর
নিজের এবং আমাদের।
প্রিয় দেশ, তুমিই একুশ, পদযাত্রায় উদ্দীপনা
রক্তের নামে লিখে যাওয়া পতাকার চারুকলা।
বর্ণমালা
মামুন রশীদ
………………………………………………………………….
বর্ণমালা, প্রেমে না অপ্রেমে তাকিয়েছিলাম, বুঝিনি।
প্রথম দেখার মুগ্ধতা তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল।
সেই রেশ, চাইনি হারিয়ে যাক, তোমাকে ছুঁয়ে
দেখা যাবে, তোমার অফুরন্ত প্রাণশক্তির ভেতর
থেকে দুঃখ আর আনন্দের ঝর্ণাধারা-
দীর্ঘ হাহাকার পেরিয়ে, আমাকে অম্লান করে রাখতে
পারে, কল্পনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, অস্ফুট শব্দ ক্রমশ
আমার হতে পারে, এই ধারণা তুমুল সাক্ষ্য দিতে
থাকে-টকটকে শিমুলের ঝরে পরার ভেতরে।
বর্ণমালা, রক্তাক্ত যে যাত্রার ভেতর দিয়ে তুমি চিরজাগরূক
আবিস্কারের আগেও যেমন ছুটেছে সময়, তার রথে তোমার
জন্য বিনীত ভাষায় পৌঁছে দিলাম-ভালোবাসা।
বাংলাভাষার উত্তরন
কাকলি মান্না
………………………………….
ভাষাকে দাও সত্যের স্বাদ
স্বাধীনতা হোক অভ্যাস
ভাষায় দেখ উৎসবের আলো
মননের গভীরে গাঁথ অক্ষরমালা
ভালোবাসা বাংলাভাষা
কাঁটা তার হোক রেশমী সুতোর
পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকি অভিন্নতায়
আগামীর স্বপ্নে থাকুক
একমুঠো মুক্ত আকাশের অঙ্গীকার
আমার শরীর জোছনা মেখে
মৃদু স্বরে বলে আমি তোকে নিয়ে বাঁচি
সব “আমি” র এক সুর
ঘুমন্ত রক্তের মধ্যে লুকোনো ব্যাকরণে
আমার বাংলা ভাষায় আত্মীকরণ
তিরাশি শব্দের একটি চিঠি
মাহফুজা অনন্যা
……………………………………
একটি অনাথ শিশু
কেউ তার নাম জিগ্যেস করলে সে ভালো করে বলতে পারেনা ‘বাংলাদেশ’…
বাংলাদেশ একটি অনাথ শিশু যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে
কেউ জানেনা তার ঠিকানা
কাঁদে একা দিনরাত
মাঝেমাঝে কেউ চোখ মুছিয়ে দিলেও ঠিকানা দিতে পারেনা অভিভাবকের…
আকাশের দিকে প্রসারিত করে করুণ হাতখানি
প্রার্থনায় কাঁপে ঠোঁট
তবু কোন করুণা তাকে তুষ্ট করতে পারেনা!
যত্নহীন অনাহারী মুখ বৃদ্ধ নারীর কুঞ্চিত স্তনের মতো নিম্নদিকে ঝুলে পড়েছে…
একটি দেশ কেঁদেকেঁদে পথের ধারে নির্বাক শুয়ে থাকে
পিপাসায় এমন কাতর যে পান করে আপন অশ্রু –
++++++++++++++++++++++++++
গীতল চোখে একুশ
মাশরুরা লাকী
………………………………………………………
একুশ আমার গীতল চোখে প্রথম অহংকার
শিমুল-পলাশ গেয়ে ওঠে প্রভাতফেরির গান
আমরা সবাই অসাধারণ নির্জলা বদনাম
ভাষাও কাঁদুক পথে
কেউ বা ভীষণ উৎফুল্ল বেদম অগ্নিরথে।
অচেনা এক প্রভাতে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে শুনি
একদল তরুণের তাঁতেবোনা ব্যঙ্গ বর্ণমালা
আধুনিকতার ভুলের জয়ধ্বনি
কতো অভিযোগ কতো নালিশ দীর্ঘশ্বাসের ন্যাপথলিন
গন্তব্যের কাছাকাছি হাসে বিজ্ঞের লেজুড়ে পাণ্ডুলিপি।
ক্লান্ত অনুতাপে ঘোষণা দিচ্ছি
হে শহীদ বীর অবিনাশী আত্মার হাহাকারী দল-
আমাদের ক্ষমা করে দিও
রাত্রির নরোম ঠোঁটে ফুটেছিল যে লাল কৃষ্ণচূড়া
ঘাতকের এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে যার অমোঘ সর্বনাশ
তোমাদের সাধের বর্ণমালার মিথ্যা জলাঞ্জলি
ক্ষমা করে দিও আমাদের অভিলাষী এ মাদল।
সেলাইমেশিনে রিফু করি আজ রক্ত-বর্ণমালা
তালি মেরে মেরে মন্দির-মিনার প্রমাণ করি বাংলা আমার মাতৃভাষা
মেখে থাক অবজ্ঞা আর ভুলে ভরা অবহেলা।