কবিকে বুঝতে তাঁর উপলব্ধির স্বরে খোঁড়াখুঁড়িঃ
চকশ্লেটে লেখার হাতেখড়ি শিশু এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পড়ার ফাঁকে দুপুরের ভাতঘুমে মায়ের বুকে থাকা কৈশোর এখন কয়জন পায়? দুপুরের ভাতঘুমে মায়ের বুকে চোখ মুদে ঘুমের ভান করে মায়ের পড়া উপন্যাস নিমাই ভট্টাচার্য এর ‘মেমসাহেব ‘, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ কিংবা রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের বইগুলো মুখস্ত নয় বানান করে যে পড়ে, তাঁর ভেতর তৈরি হয় পাঠ ক্ষুধা। এমন এক পাঠ ক্ষুধা যা পড়তে পড়তে একজন কিশোরী সেই মেয়েবেলায় মফিজুলদের পাঠশালার কয়েকশত বই গোগ্রাসে পাঠ করে ফেলে। একজন কবি কখনোই হওয়া যায়না।কবি হয়ে জন্মাতে হয়। কিশোরীবেলায় যে মেয়েটি এভাবে পঠন পাঠনের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠেন, তিনি যে সুপ্তকবি তা কেই বা জানতো! ছেলেবেলায় লাইব্রেরিতে বই পাঠ করতে যেয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দিন পাঠ শেষে হয়ত মনের অজান্তেই একটা বিশেষ ডায়েরিতে লেখালেখি শুরু হয়ে যায়। পিতার দেয়া ফাউন্টেন পেন পদাধিকার বলে বড়ো বোন পায়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কলম চুরি করে ডায়েরিতে লিখে একজন যখন কালিই শেষ করে ফেলে,তখন চিন্তা করতে হবে, এই লেখালেখির ভবিষ্যৎ ইংগিত কি?? আমি জান্নাতুল কেকার ” ফ্রকের ঘেরে শৈশব ” কবিতাগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করার আগে একটা ধারণার মধ্যে দিয়ে কবিকে চিনিয়ে দেয়ার মতলব করছি। এবার কবির জবানিতে শুনুন,” বড়পা করুণ অবাক হয়ে আমাকে মাপত। ভাবত, কালি তো শেষ হবার কথা নয়।কারণ, কালি ফুরিয়ে যাবে ভেবে নিজে না লিখে কলমটি পরম যতনে লুকিয়ে রেখেছিল। সেই ফাউন্টেন কলমে আমার কবিতা লেখার কাজ ভালোই জমেছিল।হঠাৎ মাঝরাতে উঠে বসতাম বিছানায়। তারপর ঘরের মাঝখানে রাখা চিমনিটা চারদিকে সমান আলো দেবে এমন দূরত্ব থেকে তুলে নিতাম বিছানায় মাথার কাছে। নিবু নিবু আলোতে কত লিখেছি। সেসব লেখা রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা শরৎচন্দ্রের গন্ডির আশেপাশেও ছিলনা সত্যি ; তবে ঐসব লেখা আদৌ কবিতা বা গল্প হয়েছিল কিনা তা বিচারের কোনো সুযোগও ছিলোনা। “। উপলব্ধির স্বরে কবি নিজেই কাব্যগ্রন্থের শুরুতে একথা বয়ান করেছেন। এবং কবির চিমনির আলোয় লেখালেখির এই সময়টা মধ্য আশি। সেই খাতাটা কবির হারিয়ে গেছে। কিন্তু ” ফ্রকের ঘেরে শৈশব ” কবিতার মধ্যে তাঁর রচিত শৈশবের তিনশত পঁচাত্তর টি লেখনি লুকিয়ে আছে। এই বাক্যটি পড়ার পর আমার কৌতূহল বেড়ে গেলো। তাহলে এই ‘ ফ্রকের ঘেরে শৈশব ‘ কবিতাটি ভালো করে তেলাওয়াত করলেই পুরো কাব্যগ্রন্থটি বোঝা যাবে।
আমরা প্রবেশ করছি কবিতার আঙিনায়ঃ
পঁচাশি সালে যে লেখক তিনশত পঁচাত্তরটি লেখা ডায়েরিতে লিখে ফেলেন এবং পরের পয়ত্রিশ বছর পর একটা কবিতার বই পাঠকের সামনে হাজির করেন, তখন রবীন্দ্রনাথের মতো ” কে তুমি বসে পড়িছো আমার কবিতাখানি, কৌতুহলভরে”র মতো আমাদেরও কৌতুহল জাগে। আদ্রে রেবো যখন বলেন, একটা কবিতার মধ্যে একটা লাইনই যদি কবিতা হয় তাহলে পুরোটাই কবিতা। গভীর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে জান্নাতুল কেকার ‘ফ্রকের ঘেরে শৈশব ‘ কবিতাটি নিয়ে আমরা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করলাম। বিজ্ঞানীদের ভাষায় চিৎকার করে বলে উঠি “ইউরেকা”। কবিতা পেয়েছি। কবিতাটির শুরু এভাবে, ” ফ্রকের ঘেরে হারানো শৈশব /আমার আজো ছোটে গোল্লাছুটের মাঠে”…। সাদাসিধা কথা। কিন্তু একটা চিত্র এঁকেছেন কবি। কিশোর বা কিশোরীবেলায় গোল্লাছুট খেলাটা ছিলো একটা প্রাত্যহিক বিকেল রুটিন। সেই খেলায় দৌড়াদৌড়ি ছিলো, ছিলো টানটান উত্তেজনা, খামাখা চিৎকার। এই দুই লাইন পাঠ করা মাত্র আমাদেরকে কবি একটানে উঠিয়ে নিয়ে যান কিশোরবেলায়। মনে পড়ে যায় আমার শৈশবকাল। কবিতা পাঠ করতে হয় ধ্যানের সাথে। তাহলে এর রস আস্বাদন করা যায় পুরোটা। নইলে চোখ বুলালে কিংবা শুধু পাঠ করলে কবিতার আসল স্বাদ পাওয়া যায় না। কবিতার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কবিতার কোনো সূত্র নেই। কবিতার ছন্দবিজ্ঞান আছে। কবিতা এগিয়ে যায় কবির আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে আবেগের ডানায় চেপে। কবি যখন লিখেন,
“ফ্রকের ঘেরের জালে আটকে যেত
চুনোপুঁটি আর টাটকিনির পোনা
লম্বা ঘেরের ফ্রকে রোদ্দুর লাগা
বৈকালের মাঠে হাওয়ায় উড়ত অবলীলায়।
ফ্রকের ঘেরের ফাঁকে উবু হয়ে পশ্চাদ্দেশ
দিয়ে দেখা যেত আকাশের জমিন”
( ফ্রকের ঘেরে শৈশব, পৃষ্ঠা ১৬)
‘ফ্রকের ঘেরে শৈশব ‘… কবিতাটি আটাশ লাইন। এই কবিতা নিয়ে কবি বয়ান করছেন নিজের উপলব্ধির স্বরে।তিনি বলছেন,”তবে একটি কবিতায় আমার স্মৃতিতে ভিন্ন ভাবে ভিন্ন উপলব্ধিতে ফিরে এসেছে- আমার প্রথম গ্রন্থ ‘ফ্রকের ঘেরে শৈশব ‘।এই একটি কবিতাই আমার আবাল্যের অনুভূতি থেকে এখনো আমার সঙ্গী। গল্প-কবিতা মিলিয়ে প্রায় পৌনে চারশ। হারিয়ে যাওয়া সেই লেখনির প্রতিনিধিত্ব করছে আমার প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘ফ্রকের ঘেরে শৈশব ‘।
উপরের ছয় লাইনে কবি খুব সাধারণভাবে লিখেছেন। কিন্তু এর চিত্র এঁকেছেন অসাধারণ। আমরাও হারিয়ে যাই কবির পংক্তির মাঝে। মনে হয়, আরে আমরাও তো গামছা পরে করতোয়ার জলে পুঁটি মাছ ধরার অদম্য বাসনায় ঝাঁপিয়ে পড়তাম।মনে হতে থাকে এ লাইনগুলি জান্নাতুল কেকা লিখেননি, এ লাইনগুলি আমিই লিখেছি। এ কবিতার সার্থকতা এখানেই। প্রত্যেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে যাবেন নিজের ছেলেবেলা একলাফে হাজির হয়ে যায় জান্নাতুল কেকার কবিতার বজরায় চেপে।
০২.
উনত্রিশটি কবিতার ডালি নিয়ে কবি সাজিয়েছেন তাঁর কবিতার বাগান। প্রতিটি কবিতার মাঝেই এক ধরনের মোচড় আছে। আছে আবেগ। আছে বাস্তবতার সব রসদ। কবি কবিতাকে নিয়ে নিরিক্ষার দোলাচালে উপনিত হননি। সহজ ভাষায় বয়ান করেছেন কবিতা। চিত্রকল্প আঁকার ক্ষেত্রে তিনি সাবলীল। যেভাবে এগিয়েছেন, প্রকৃতি যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই আয়োজন করেছেন কবিতার ছবি। তিনি যখন বলেন, ” আকাশের এলোকেশের উন্নাসিকতায়/নামে ঘনঘোর আঁধার।( আকাশের উন্নাসিকতা, পৃষ্ঠা ১৩)। কিংবা “ওহ পথ,তুমি নিয়ে চলো তোমার গন্তব্যের শেষ প্রান্তে /চলতে চলতে তৃষ্ণার্ত হবো,কিন্তু ক্লান্ত হবোনা!/একদিন পথের খোঁজেই পথে নেমেছিলাম দুর্বার-গতিহীন।/পেয়েছি অসংখ্য পথের দিশা (পথ,পৃষ্ঠা ১১)। কবিতাগুলো লক্ষ্য করি। নিরীহ বাক্য। কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যায়। সংগ্রাম করে মানুষ এগিয়ে যায়। অচেনা নগরীতে মানুষ একদিন ঠিকই ঠিকানা খুঁজে বের করে। অসংখ্য পথ মানুষ খুঁজে বের করে জীবনের জন্য, জীবিকার জন্য। কবি এই সরল কথাগুলো সাবলীলভাবে কবিতায় গেঁথেছেন। কবিতাকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ঘনকালো মেঘকে কবি এলোকেশের উন্নাসিকতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। যাপিত জীবনের বিষয় আশয়কে কেন্দ্র করে কবি লিখেছেন তাঁর কবিতা। অনেকেই যেখানে কঠিন বিষয় নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হন, সেখানে কবি হাজির হয়েছেন সাধারণ জেলে সমাজ নিয়ে। যেমন লক্ষ্য করুনঃ
” মাছের খলুইতে চাপা ভালোবাসা
শিং-কই-মাগুরের লম্ফেঝম্ফের খলখলানি
পাশাপাশি ফিরে ভাবের উত্তাপ ছড়ায়
দাপিয়ে জানান দেয় উদরপূর্তির প্রস্তুতি
তারপর খলুই নিয়ে পথে নামে চাষি
ভালোবাসা বিকাতে বাজারদরে
(উদরপূর্তি ভালোবাসা, পৃষ্ঠা ২৪)।
এভাবে কবি প্রতিটি কবিতার মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা থেকে আজকের করপোরেট সমাজ ব্যবস্থার চিত্র এঁকেছেন। কবিতা কোন কালের প্রতিনিধিত্ব করে?? এপ্রশ্নের বাহিরে গিয়ে বলা যায়, কবিতা যখন যিনি পাঠ করবেন, তখন যদি মনে হয় কবিতাটা এসময়ে প্রতিনিধিত্ব করছে তাহলে সেই কবিতা সময়োপযোগী ও উত্তীর্ণ। কবিতাকে শেষ পর্যন্ত কবিতাই হতে হয়, তা পদ্যের ঘোড়ায় চেপে হউক কিংবা গদ্যের হাত ধরে। কবিতা পাঠে যদি আলো আঁধারের ছায়ার মধ্যে একটা অবয়ব আবিষ্কার হয় তখন মনে হয় এটা একটা কবিতা। জান্নাতুল কেকার প্রথম কাব্য গ্রন্থ হলেও একথা বলা যায়, কবিতার রাস্তায় পথ চললে এই কবি একদিন সৃষ্টির আনন্দ পুরোটা পাবেন। কারণ, সাহিত্য একটা জীবন চায়। কবিতা চায় চলমানতা। কবি সে পথে হাঁটছেন, একথা বলা যায়।