১৮৪০ সালে “প্রভাকর” পত্রিকায় প্রথম পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপার গোড়াপত্তন। আর এটি নতুন মাত্রালাভ করে কবিগুরুর হাত ধরে। বিজ্ঞাপন কতটা সংক্ষিপ্ত, মার্জিত ও অর্থবহ হতে পারে তা বিজ্ঞাপন গুলো পড়লেই বোঝা যায়। তখনকার বিজ্ঞাপনে ছিলোনা মাত্রাতরিক্ত প্রতিশ্রুতি। বলা হতো না যে, এই বডি স্প্রে ব্যবহার করলেই পিছনে ছুঁটবে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণী,, পানীয় পান করলেই পাবেন হেব্বি এনার্জি,,, স্বাস্থ্যবর্ধক খেলেই হবেন “টলার,স্ট্রংগার আর শার্পার”। ছিলো দেশী পন্য ব্যবহারে উৎসাহিত করে দেশপ্রেম জাগ্রত করার বানী। বিজ্ঞাপন জগতকে আলোচিত করেছেন তাঁর সৃজন ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে, এনেছেন নতুন মাত্রা।
“মডেলরা যেভাবে অঙ্গ ভঙ্গি করে মনমাতানো হাসির ঝিলিক দিয়ে বিজ্ঞাপন করেন”। কবি ওভাবে বিজ্ঞাপন করেন নি। সকল বিজ্ঞাপনে তাঁর বিখ্যাত গোঁপ-দাড়িওয়ালা ছবি আর স্বাক্ষরসহ থাকতো নির্দিষ্ট পণ্যের সম্পর্কে কিছু কথা।
সেকালের স্বদেশী শিল্পপতির একটি প্রসাধনী পণ্য”‘রেডিয়াম ক্রিম’। বিদেশী শিল্পপতিদের বাজারকে প্রতিহত করতে কবি দেশীয় এই প্রসাধনী পণ্যে লিখলেন :
“রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টারির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।”
সেই সময়কার অন্যতম সাবান প্রস্তুতকারক কোম্পনী গোদরেজে সাবানের বিজ্ঞাপনে কবি লিখলেন ” I know no other foreign soaps better than Godrej’s and I well make a point of using Godrej” “গোদারেজের সাবানের তুলনায় কোন বিদেশীয় সাবান এত উৎকৃষ্ট আছে কিনা তাহা আমার জানা নাই। ভবিষ্যতে আমি গোদারেজের সাবান ব্যবহার করিব বলিয়াই স্থির করিয়াছি।” এই বিজ্ঞাপনটি বেরিয়েছিল তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ তারিখে।
“দেশজ পণ্যসামগ্রী সম্পর্কিত কবিগুরুর অভিমতগুলো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল । সেই সময়কার বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথকে এমন ব্যাপকহারে বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছিল যেমনটি আর কারও ক্ষেত্রে হয়নি বলা চলে। কালি-কলম থেকে শুরু করে মাথার তেল, ক্রিম, সাবান, মেশিনারি, রেকর্ড (কোম্পানী) এমন কি মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যন্ত কবিগুরু কে অবাধে ব্যবহার করেছিল।”
১৩৩৮ সালে বিখ্যাত কুন্তলীন সুগন্ধী তেল প্রস্তুতকারক হেমচন্দ্র বসু কবিকে এসে বললেন, তার কোম্পানীর জন্যে কবিকে একটা জুৎসই বিজ্ঞাপন লিখে দিতে হবে। কবি মার্জিত ভাষায় লিখলেন,
“কুন্তলীন তৈল আমরা দুই মাসকাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার কোন এক আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুল উঠিয়া যাইতেছিল ; কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া একমাসের মধ্যে তাহার নূতন কেশোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত এবং ব্যবহার করিলে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না।”
আর সাথে লিখলেন হেমচন্দ্র বসুর প্রশংসা করে ছোট্র একটি কবিতা,
বৈষয়িক হেমচন্দ্র সেটাকেও বিজ্ঞাপনে পরিনত করলেন (ছবি দ্রষ্টব্য)।
কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, ;- “কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া একমাসের মধ্যে নতুন কেশ হইয়াছে।”
“কুন্তলীনে’র গুণে মুগ্ধ হইয়াই কবি গাহিয়াছেন,
“কেশে মাখ “কুন্তলীন ”
রুমালেতে “দেলখোস”
পানে খাও “তাম্বলীন”
ধন্য হো’ক “এইচ বোস”,,
ঝাঁনু ব্যবসায়ী হেমচন্দ্র বসু ব্যবসাটা খুব ভালোই বুঝতেন। তিনি ব্যবসা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তা হলো- ১৩০৩ সালে তার আবিষ্কৃত সুগন্ধী ‘দেলখোশ’ ও কেশতৈল ‘কুন্তলীন’ নিয়ে গল্প প্রতিযোগিতার কথা ঘোষনা করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন এবং গুণমান বিচারে পুরষ্কারও ঘোষনা করলেন। বিজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, গল্পে সুগন্ধী দেলখোশ ও কুন্তলীন কেশ তৈলের উল্লেখ থাকতে হবে। গল্পের মান অনুযায়ী পঁচিশ টাকা হইতে পাঁচশ টাকা পুরষ্কার দেয়া হবে।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র ‘মন্দির’ নামক গল্পটি ‘সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়’ ছদ্মনামে লিখে পঁচিশ টাকা মূল্যমানের পুরষ্কার লাভ করেন। সে গল্পে শরৎচন্দ্র কেমন করে শর্ত অনুযায়ী দেলখোশ ও কুন্তলীন শব্দ দুটি উল্লেখ করেছিলেন, তা একটু দেখে নেয়া যাক; গল্পের একটি অংশে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন :
“লজ্জায় মরিয়া গিয়াও সে (নায়ক অমরনাথ) বাক্সের ডালা খুলিয়া গোটাকতক কুন্তলীনের শিশি, আরো কি কি বাহির করিতে উদ্যত হইল। অপর্ণা (গল্পের নায়িকা) বাধা দিয়া কহিল, ‘এনেছ কি আমার জন্য ?’ অমরনাথের হইয়া আর কে যেন জবাব দিলে, ‘হাঁ, তোমার জন্যই এনেছি দেলখোশগুলো।’
অপর্ণা জিজ্ঞাসা করিল ‘বাক্সটাও কি আমাকে দিলে ?
‘নিশ্চয়।’
চলবে…..
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক✍ হাসান হাফিজুর রহমান।