প্রতারণার ভিড়ে সম্মাননার পুরস্কার মাঝে মাঝে বিদ্রুপের খোরাক হয়ে ওঠে। শান্তির নোবেল পৃথিবীতে নৈরাজ্য আর অশান্তির স্মারক কিনা সে বিষয়ে দিনভর বিতর্ক করা যায়। যেহেতু বিশ্ব রাজনীতি তথা বিশ্ব শান্তি পুঁজিবাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত তাই পুঁজিবাদের দালালিই এখন আন্তর্জাতিক সম্মাননার পূর্বশর্ত। স্বার্থের শর্তে জর্জরিত এসব আন্তর্জাতিক পুরস্কারগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক প্রহসনে পরিনত হয়েছে। খেলার মাঠে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ অমুক না হয়ে তমুক হতে পারতো এমন বিতর্ক খেলার পুরো সিরিজ জুড়ে চলমান থাকে।পুরস্কারের দলীয়করণ নিয়ে কচলা-কচলি সেও নতুন কথা নয়। রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় ব্যক্তির নিজস্ব প্রত্যাশার প্রতিফলন না হলে পুরস্কার প্রত্যাশীরা ফেসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ জানান এবং সেই ক্ষোভের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রত্যাশিত পুরস্কারটিও জুটে যায়, এমন ঘটনাও নিকট অতীতে ঘটেছে। সুতরাং সম্মাননার এসব স্মারক সময়ে সময়ে বিতর্কের স্মারকে পরিণত হয়। সম্মাননা দেয়ার আগে জুরি বোর্ড বা কর্তৃপক্ষের বিচার ও বিবেচনার পদ্ধতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিতর্কের মুল কারণ। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে ‘পদক বানিজ্য’ সম্মাননা বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এখানে পুরস্কার দেয়ার কর্তৃপক্ষের বিচার বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন নেই, কারণ যারা পদক বাণিজ্যের সাথে জড়িত অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বীকৃত কোন কর্তৃপক্ষই নয়। মৌসুম বুঝে তারা পুরস্কার নামক প্রতারণার পসরা সাজিয়ে বসে। বাংলাদেশে অসংখ্য ভূইফোড় সংগঠন নামে-বেনামে পদক বাণিজ্যকে উপার্জনের অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে এখন এই এওয়্যার্ড, পুরস্কার বা পদক ব্যবসার রমরমা অবস্থা। সামাজিক স্বীকৃতিলোভীদের অসততার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই এখন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বলা যেতে পারে, অনেকের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে এই ব্যবসা। একটি পুরস্কার বা পদক পুঁজি করে সমাজে নিজেদের স্ব স্ব অবস্থান তৈরি করে নিতেও সক্ষম হয়েছে এসব পুরস্কার-ব্যবসায়ীরা। ঢাকায় এসব পদক-পুরস্কারের বাজার নিম্নমুখী হওয়ার কারণেই শহরের পাশাপাশি মফস্বলের দিকে তারা পদক বাণিজ্য সম্প্রসারণে দৃষ্টি দিয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, এই পুরস্কার ও পদক-ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দেশের বিভিন্ন এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পুরস্কার প্রদানের লাভজনক কাজটি করে যাচ্ছে। জুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতির লোভ দেখিয়ে টার্গেট করে বিশেষ বিশেষব্যক্তিকে পুরস্কার নিতে প্রলুব্ধ করে, পরে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায়ের খবরও উঠে এসেছে সেই প্রতিবেদনে।
পরিচয় যাই হোক না কেন, টাকা দিলেই মিলছেবাহারী নামের বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা। বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে দেয়া হচ্ছে এসব পদক। পদকপ্রাপ্তদের তালিকায়ও দু’একজন বিখ্যাত লোক থাকেন।এটি পদক ব্যবসায়ীদের এক ধরনের কৌশল। কৌশল হিসেবে প্রথমে মেইল আইডি অথবা ডাকে একটি আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়। এরপর নাম-ঠিকানা, ছবি ও কোন বিষয়ের উপর পদক নিতে চায়, এই তথ্য সংশ্লিষ্টপুরস্কার প্রত্যাশীর কছে জানতে চাওয়া হয়। এমন লোভনীয় আমন্ত্রণে সাড়া দিলে তাদের সাথে দ্বিতীয় দফায় যোগাযোগ করে পদক প্রদান অনুষ্ঠানের অনুদান চাওয়া হয়। পদক পেতে হলে দশ হাজার টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। ক্রেস্ট বা পদকের মূল্য, অনুষ্ঠানের খরচ, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের‘ খাম-খরচ’ হিসেবে ব্যয় হয় পুরস্কার প্রত্যাশীদের দেয়া অনুদান। ক্ষেত্রবিশেষ পদকের ‘মূল্য’ নিয়ে দরকষাকষিও করে এসব ভূইফোড় সংগঠন। শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা, সমাজসেবা, কৃষি, রাজনীতি, শিল্প, সংগীত, সাংবাদিকতা ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে সম্মাননা ও পদক দেয় তারা। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সাহিত্যিক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিক্ষাবিদ খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর, বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, কবি সুফিয়া কামাল-এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে দেয়া হয় সম্মাননা পদক। এছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন বিশেষ দিবসকে কেন্দ্র করেও দেয়া হয় পদক। বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে নাম ও প্যাড সর্বস্ব গবেষণা পরিষদ বানিয়ে এ রকম অসংখ্য পদক ও সম্মাননা দিচ্ছে অবৈধ এই সংগঠনগুলো। কিছু নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানও সচেতন ও সতর্কভাবে পদকের ব্যবসায় মেতে উঠেছে। তারা তাদের নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে সম্মাননা ব্যবসাকে আয়-উপার্জনের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিছু কিছু নামসর্বস্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানও এর সাথে জড়িত। আর পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকায় থাকে রাজধানীর বাইরে থেকে আসা পৌরসভার মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য, নেতা-পাতিনেতা, টাকাওয়ালা সমাজসেবক এমন কি আলু পটল ব্যবসায়ি থেকে স্মাগলার, অবৈধ ব্যবসায়ী, ছোটখাট এনজিও, ভুয়া হারবাল কোম্পানী, সর্বরোগ বিশেষজ্ঞ হোমিও ডাক্তার, ভন্ড জ্যোতিষ রত্ন ও বিভিন্ন পেশাজীবী। মফস্বলের এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান টাকার বিনিময়ে পদক ও সম্মাননা নিয়ে শোকেচভর্তি করে, প্রতারণার এই স্মারক প্রয়োজনমতো প্রদর্শন করেতৃপ্ত হয় আর স্থানীয় পর্যায়ে ব্যানার পোস্টারে নির্লজ্জের মতো লেপ্টে বেড়ায়। এসব পদক-পুরস্কার তার কর্মপরিধির সাথে প্রাসাঙ্গিক কিনা তাও ভেবে দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসা সেবার জন্য সাহিত্য পুরস্কার, নয়তো ব্যবসার জন্য শিক্ষা পুরস্কার পেয়ে বসে আছে!
আমার পরিচিত একজন উঠতি ব্যবসায়ী তার অফিসের নিজ কক্ষের তিন দেয়ালজুড়ে এমনভাবে বিভিন্ন ক্রেস্ট ও স্মারক সাজিয়ে রেখেছেন যে, প্রথম দেখায় মনে হবে এটি কাটাবনের ক্রেস্টের দোকান। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির নামে, কিন্তু একই ডিজাইনের এবং একই তারিখে প্রদত্ত এসব ক্রেস্ট কতোটা হাস্যকরভাবে তার পিছন থেকে উঁকি মারে- খ্যাতির লোভে সেই বোধ তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের সম্মান ও মর্যাদা জানান দিতে কি অদ্ভুত আয়োজন! সম্প্রতি আমার এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য সমাজসেবায় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা পদক পেয়েছেন। যোগাযোগ করায় তিনি জানালেন- ‘জাতীয় ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংস্থা’ তাকে এই সম্মাননা দিয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম বাংলাদেশে এই সংস্থার অস্তিত্ব আছে কিনা, এবং থাকলেও আহ্ছানিয়া মিশন বা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনিস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে ওই সংস্থা খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার নামে পদক কিভাবে দেয়? তিনি বললেন, রাজনৈতিক সফলতার মাঠে পদকটি তার প্রাপ্য। কারা কিভাবে পুরস্কার দিচ্ছে এটা তার ভাবনার বিষয় নয়। তিনি বিশ্বাস করেন সামান্য কিছু খরচের বিনিময়ে এ ধরণের পদক তার সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে। মজার বিষয় হলো যারা সমাজসেবায় এ ধরণের পদকগুলো গ্রহণ করছেন তারা সেই ‘সামান্য কিছু খরচ’ সামাজিকদায়ে কাজে না লাগিয়ে পুরস্কার কিনতে ব্যয় করছেন। এর মাধ্যমে তারা যে প্রতারণা করছেন সেটা তো মানছেনই না, বরং প্রতারণার ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে নিজেকে সম্মানিত ভাবছেন। সম্মাননালোভী এবং পদক বাণিজ্যের সাথে জড়িত এসব অসৎ মানুষ বিখ্যাত মানুষের নামকে ব্যবহার করে অপরাধ করছেন কিনা এসব কি কারও ভাববার বিষয় নয়?
খ্যাতিলিপ্সু কিছু কাঙাল ও অর্থলিপ্সু কিছু ভূইফোড় সংগঠন উভয়ই পদক বাণিজ্যের প্রতারণায় সমান অপরাধী। তাদের কারণে পদক, পুরস্কার ও সম্মাননা সামাজিক মর্যাদার পরিবর্তে হাস্যরসে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে সম্মাননালোভী ব্যক্তিরা নিজেদেরকে উপস্থাপন করছেন হাস্যকৌতুকের উপকরণ হিসেবে পাশাপাশি সমাজ বির্নিমানে যাদের সত্যিকার অবদার রয়েছে তাদেরকেবিড়ম্বনায় ফেলে দিচ্ছেন। পদক ও সম্মাননার এমন অপপ্রয়োগ দেখে প্রকৃত সম্মানিত ব্যাক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান আজ অনেক ক্ষেত্রেই লজ্জিত হন। বিশেষ করে যারা যোগ্যতায় সম্মাননা অর্জন করেন তারা পদক কেনাবেচার খবরে বিব্রত হন। গজিয়ে ওঠা কথিত সমাজসেবীরা প্রকৃত সমাজসেবীদের সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছেন। যেসব বিখ্যাত মণীষীদের নামে এসব পদক-পুরস্কার দেয়া হচ্ছে সেসব মণীষী কিংবা সে সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে পদক ব্যবসায়ীদের কোন সংশ্লিষ্ঠতা নেই। সুতরাং পুরস্কারে এসব মনীষীদের নাম ব্যবহার করা তাঁদের অপমানেরই নামান্তর। বছরের পর বছর এই অনৈতিক পদক ব্যবসা চলছে। কিন্তু প্রতারণার এই কান্ড-কারখানা দেখেও যেন দেখার কেউ নেই। এই পুরস্কার-প্রতারণা বন্ধের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। দিনের পর দিন বাড়ছে পুরস্কার-ব্যবসায়ী ব্যক্তি ও সংগঠনের সংখ্যা, বাড়ছে পদক বাণিজ্যের নতুন বাজার!
পদক ও সম্মানের নেশা ইদানিং মাদকের মত সংক্রমিত হচ্ছে মহামারী আকারে! হাস্যকর হলেও সত্য মাদকাসক্তের মতো মানুষ এখন পদকাসক্ত। পদ পদবীর প্রচলন আগেও ছিল কিন্তু পদকের ছড়াছড়ি বর্তমান মাত্রায় ছিল না। পুরস্কার ও সম্মাননায় মানুষের এক চিরন্তন ভাল লাগার অনুভূতি আছে। আছে তৃপ্তি ও মর্যাদার ভালোলাগা। হালে চটকদার ও বাহারি নামের কথিত সম্মাননা এবং পদকের প্রচলন এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, মানুষের কাছে এগুলো এখন আলু-পটলের মতো সস্তা হয়ে গেছে। মর্যাদায় মাখা অর্জিত সম্মানকে যারা টাকায় কেনা প্রতারণার সম্মান দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন তাদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিহত করা প্রয়োজন। জাতীয় পর্যায়ে সরকারি অনুমোদন ছাড়া যারা পুরস্কার দেয় তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। স্থানীয় পর্যায়েও ব্যক্তিনামে প্রবর্তিত পুরস্কারের ওপর যথাযথ কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণ থাকলে পদকের অপপ্রয়োগ কমবে। সামাজিক স্বীকৃতির আশায় যারা পদক- পুরস্কারকে তাবিজ মনে করে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করার জাতীয় প্রচারণাও কাজে দেবে বলে বিশ্বাস করি। বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননা ও পুরস্কারের ভবিষ্যৎকে বিবেচনায় নিয়ে ভূঁইফোড় নামসর্বস্ব সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি প্রতারণার শামিল এই অনৈতিক পদক বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Email: monirulislamprism@gmail.com