১৮৬৪ সাল ৭ ই ফেব্রুয়ারি, গ্যাডস হিল প্লেস, কেন্ট -এ মহা ধুমধাম করে ৫২ তম জন্মদিন পালন করা হচ্ছে “ক্রিসমাস ক্যারল” এর লেখকের। নিজ বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত ভিক্টোরিয়ান যুগের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। এমন সময় সে বাড়িতে একটা চিঠি এলো, প্রেরক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রেসিডেন্সি, ফোর্ট উইলিয়াম, ক্যালকাটা। সবার কৌতুহল কি আছে সেই চিঠিতে? কোম্পানি এনভেলপে অস্পষ্ট মুখ দেখতে পেলেন নিজের ২য় পুত্র ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডর ডিকেন্স এর। ক্ষণিকে অনেক স্মৃতিই মনে পড়লো, ছেলেটা তার মতোই লেখক হতে চেয়েছিলো। কি লাভ তাতে? দেখতেই পাচ্ছ বাবার কি অবস্থা, কেমন আছি তোমার ন’ভাইবোন নিয়ে। এরচেয়ে ঢের ভালো কোম্পানির সৈনিক হওয়া। রাজকীয় বাহিনীর অফিসারের চাইতেও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাধারন সৈনিকের বেতন কয়েকগুণ বেশী। প্রায় জোর করেই হুড়হাঙ্গামা অপছন্দ করা ছেলেটাকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইষ্ট ইন্ডিয়ায় পাঠিয়েছেন অন্যান্যদের মতোই দ্রুত ভাগ্য পরিবর্তনের গ্রেট এক্সপেকটেশন নিয়ে। প্রায় ছয় বছর হলো ছেলেটার মুখ দেখা হয় না, আহ্। ছোটবেলায় ওকে Young skull বলে ডাকতাম, সেই বাচ্চা খুলি এতদিনে Officer Cadet থেকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রেসিডেন্সি আর্মির লেফটেন্যান্ট হয়েছে। ওখান থেকে আসবে কাঁড়িকাড়ি রত্ন, সোনারুপা, তবে নেটিভ সিপাইরা নাকি রিভোল্ট করেছে শোনা যাচ্ছে। তারপরও আত্মীয়স্বজনের কাছে তাদের গুরুত্ব বেড়েছে, এতদিনে নিশ্চয়ই ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। কাঁপা হাতে এনভেলপ খুলে চিঠিতে নজর বুলিয়েই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। জন্মদিনের জাঁকজমক অনুষ্ঠানে যে খবর পেলেন তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না কেউই।
“ গত ৩১’শে ডিসেম্বর ১৮৬৩ তারিখে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রেসিডেন্সি বেঙ্গল আর্মির লেফটেন্যান্ট ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডার ডিকেন্স মৃত্যুবরন করেছেন, তাঁকে ভবানীপুর আর্মি সিমেট্রিতে সমাধিস্থ করা হয়েছে”। পুত্রের মৃত্যুর সংবাদে স্বপ্নেরও টুইষ্ট ঘটে যায়। এ যেন হরিষে বিষাদ!! বিগত ৬ বছর যার সাথে দেখা হয়নি, কথা হয়নি আর কোনদিন হবেও না। একজন পিতার সে সময়ের অনুভূতি আসলেই কোন ভাষায় বর্ননা করা দুস্কর। যার যায় সেইই বুঝে!!
যতদূর জানা যায় ১৮৫৭ সালের সিপাই বিদ্রোহানল ছড়িয়ে পড়ার সময় ওয়াল্টার ডিকেন্স ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রেসিডেন্সির বেঙ্গল আর্মির অফিসার ক্যাডেট হিসাবে কলকাতায় আসেন। স্থানীয় আবহাওয়া ও পরিবেশের সাথে মোটেও খাপ খাওয়াতে পারেন নি। উপরন্তু বিদ্রোহ দমনের হানাহানি তাকে ব্যথিত করে এবং লেখক হবার স্বপ্নও চুরমার হয়ে যায়। দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরী যতটা সহজে পাওয়া যেত, ছেড়ে যাওয়া ততটাই কঠিন ছিলো! ইতিমধ্যে নিষ্টুর ভাবে সিপাই বিদ্রোহ দমনের ব্যাপক সমালোচনায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে বৃটিশ রাজ ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহনের প্রক্রিয়া চলাকালে লেঃ ওয়াল্টার ডিকেন্স এর ছুটি মন্জুর হয়। ছুটিতে যাবার প্রস্ততির সময় তিনি Hematemesis (Vomiting of blood) এ আক্রান্ত হন। নিজ দেশে পাড়ি দেয়া হয়নি চিরতরে পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। ১৮৬৩ সালের ৩১’শে ডিসেম্বর অতিরিক্ত কাশির সময় শ্বাসনালী ফেটে মারা যান। তাকে প্রথমে ভবানীপুর আর্মি সিমেট্রিতে সমাধীস্থ করা হয় পরবর্তিতে তার সমাধী কলকাতা সাউথ পার্ক সিমেট্রিতে স্বানান্তর করা হয়। বৃটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী কলকাতার মাটিতেই মিশে রয়েছে চার্লস ডিকেন্স এর Young skull এর Skeleton….
চার্লস ডিকেন্স Emily de la Rue কে লিখা চিঠিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন ইন্ডিয়ার কমান্ডার ইন চিফ হতে পারলে জাত প্রথা চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন কিংবা সিপাহী বিদ্রোহের সময় এ অঞ্চল সম্পর্কে লিখেছিলেন ,” You know faces, when they are not brown; you know common experiences when they are not under turbans; Look at the dogs – low, treacherous, murderous, tigerous villains,”
হ্যাঁ, এদের মাঝেই, এ মাটিতেই চিরতরে শায়িত রয়েছে তার প্রিয় পুত্র।
**বিঃদ্রঃ ইন্ডিয়া সম্পর্কিত লেখাটি তার ব্যক্তিগত চিঠির উদ্ধৃতি। ঠগী নিয়ে লিখতে গিয়ে হঠাৎ পাওয়া তথ্য,, কোন বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, নিছক খেয়ালের বসে লিখা।
ছবি: চার্লস ডিকেন্স, উদ্ধৃতি, ওয়াল্টার ডিকেন্সের সমাধি এবং এপিটাফ
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান।।