সাংবাদিকদের পাপমোচন হবে কিভাবে?
এসব বিষয় আমরা গভীর ভাবে ভাবতে চাই
সাভারের রানা প্লাজা, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ এর নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে: স্পটে গিয়ে সাংবাদিক কি শুধুই একজন প্রফেশনাল নিউজম্যান হবেন? নাকি সামাজিক-মানবিক দায়বদ্ধতাও মেনে চলবেন? সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে কী নিজের বিবেক, মনুষ্যত্ব ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে তবেই বের হবেন কি না? এসব প্রশ্নটার জবাব পাওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
নব্বইয়ের দশকে বিখ্যাত সাংবাদিক কেভিন কার্টারের প্রসিদ্ধ একটি আলোকচিত্র এখনও সমালোচনার খোড়াক যোগায়। দুর্ভিক্ষ কবলিত সুদানে তিনি ওই ছবি তুলে পুলিৎজার পুরস্কারও পান। ছবিটি এমনÑঅল্প বয়সের একটি কঙ্কালসার শিশু অতিকষ্টে জাতিসংঘের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের দিকে এগোতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে; হামাগুঁড়ি দিয়ে সামান্য একটু এগিয়েই মাটিতে মাথা রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঠিক সেই সময় একটি শকুন শিশুটির পেছনে উড়ে এসে বসে। শকুনটি একদৃষ্টিতে মৃতপ্রায় শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল তার মৃত্যুর অপেক্ষায়। আর কেভিন তখন ব্যস্ত বিবেক বর্জিত হয়ে ‘ভালো’ একটি ছবি তোলার জন্য। ছবিটি তোলায় সফলও হয়েছিলেন তিনি। এর বিপরীতে তার কপালে পুলিৎজারের মতো পুরস্কার জুটেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আত্নদংশনে জ্বলতে থাকেন তিনি। কারণ, ছবিটি তোলার পর কেভিন কার্টার আরো ভালো, আরো আলোচিত ছবি তোলার জন্য প্রত্যন্ত এলাকার দিকে পা চালান। অনেক অনেক ভুখা নাঙ্গা মানুষের ছবি তুলে ফেরার সময় কেভিন কার্টার দেখতে পান-ছবি তোলা সেই শিশুটি সেই শকুনের আহারের বস্তু হয়েছে ততক্ষণে। সেই দৃশ্যপট নিজের মন আর চোখ থেকে কোনভাবেই সরাতে পারেননি কেভিন। দীর্ঘদিন পর নিজে আত্নহত্যা করে সেই অনুশোচনার ‘পাপমোচন’ করেছিলেন এই প্রখ্যাত আলোকচিত্রী।
বাংলাদেশের যারা সাংবাদিকতার সাথে আছি, তাদের অনেকেই এই ‘পাপটা’ অহরহ করে চলেছি। টেইলার্সে কাজ করা বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর চাইতে চাপাতির নীচে পড়া একজন রক্তাক্ত মানুষের ছটফাটানির ছবি বা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছি। রক্তমাখা বিশ্বজিতের লাল শার্টের দাম আমাদের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠেছিল। চাপাতি হাতের ১৫ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে জনা পঞ্চাশেক সাংবাদিক কিন্তু অনায়াসে রুখে দিতে পারতাম। অনেকে বলবেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ সংবাদকর্মিরা কেন করতে যাবে? কথা ঠিক, এটাও ঠিক যে- রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকান্ডে ‘যদি কেউ না আসে’ তবে সাংবাদিকরা বসে থাকতে পারি কি-না? ফেসবুকের ওয়ালে ঘুরে বেড়িয়েছে বিশ্বজিতের নৃশংস ছবিগুলো। পাশাপাশি সাংবাদিকদের নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে বিশ্ব জুড়ে। সেই ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে কতটুকু জানি না, তবে মানবিক সাংবাদিকতা উঠে যাচ্ছে হƒদয় থেকে।
ফেসবুক বা ব্লগ হলো ফ্রিল্যান্স জার্নালিজমের উৎকৃষ্ট জায়গা। সেখানে মালিকপক্ষের খবরদারিত্বের বালাই নেই, নেই রক্তচক্ষুর ভীতি। সত্য তথ্য প্রকাশ আর যৌক্তিক মন্তব্যে মুহূর্তেই গড়ে ওঠে সমর্থকগোষ্ঠী। কারো অপকর্মের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি নেয়া না নেয়ারও ঝক্কি পোহাতে হয় না। অভিন্ন মতামতের পক্ষে জোট বেধে তাৎক্ষণিক ভাবে প্রতিবাদ জানাতেও দ্বিধা করে না তারা। স্বাধীন মতামত ব্যক্তকারী সাহসী মানুষ এসব নেট ব্লগ চালায় বলেই সমাজের রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতি প্রকাশ পায় অনায়াসে। তাই তো রানা প্লাজার সংবাদ কাভার করতে গিয়ে যখন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বলেন, “উদ্ধারকার্য এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের দূরে সরিয়ে দেয়া দরকার, তা না হলে কারখানার অনেক যন্ত্রপাতিও চুরি হয়ে যেতে পারে।” এমন খবরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সোশ্যাল মিডিয়ার নেটিজেনরা। যখন হাজারো মানুষ জীবন মুত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তখন এমন মন্তব্য কিভাবে করেন সাংবাদিক! সেই সমালোচনার রেশ না কাটতেই এক সাংবাদিককে দেখা গেল, রানা প্লাজার হতভাগ্য পোশাক শ্রমিকদের জন্য খুঁড়ে রাখা সারি সারি কবরগুলোতে নেমে যেতে। তা-ও আবার জুতা পায়ে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ছবি। কিন্তু কেন? এভাবে টিআরপি বাড়াতে হবে কেন? এভাবে কাটতি বাড়াতে হবে কেন?
পত্রিকা/টিভির কনটেন্ট বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ হলে এমনিতেই কাটতি কিংবা টিআরপি বাড়বে। সত্য কখনো চাপা থাকে না। মুমূর্ষের আর্তচিৎকার বেচার দরকার নেই, কবরে নেমে লাইভ দেখানোর দরকার নেই। দরকার মনুষত্বের। দু মিনিট ক্যামেরা না চালিয়ে যদি বিশ্বজিৎকে বাঁচানো যেত আমি মনে করি সেই নিউজ হতো সবচেয়ে বড় নিউজ। আটকে পড়া নারীর আর্তচিৎকার ধারণের চেয়ে সেই নারীকে যদি উদ্ধার করা যেত তাহলে সেটি হতো আলোড়িত নিউজ। তাই সাংবাদিকতাকে কবরে পাঠানোর আগে বিবেক জাগ্রত করা জরুরি, মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা সবচেয়ে বেশি দরকার।
বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা এর ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল এর ইনচার্জ সাঈদুর রহমান রিমন