কেমন করে রাজা-বাদশা, মহারাজ কিংবা গোরা সাহেব’গণ সহ্য করতো এত গরম ? জানা যায়, বিদ্যুৎ আগমনের পূর্বে গরম থেকে বাঁচতে নানান উপকরণের কথা।
যার একটি হচ্ছে “চামর”। প্রাচীন কালে রাজ সিংহাসনের পাশে চামর হাতে দাঁড়ানো নফর যেন সিংহাসনেরই একটা অংশ। রাজ অঙ্গে মৃদু শীতল হাওয়ার পরশ দেয়াই যাদের কর্ম। শুধু ভারত বর্ষই নয়, আরব সুলতান কিংবা ঘানার গোত্রের রাজাসন পূর্ণতা পেতো মনোহরা চামরিণীর উপস্থিতিতে । চামর তৈরি করা হতো পশুর লেজের পশম কিংবা ময়ূরের পালক দিয়ে আর রাজকীয় মর্যাদা ফুটিয়ে তুলতে মহা মুল্যবান রত্ন যোগ। বাংলায় পূজো অর্চনা কিংবা গুরু দুয়ারায় চামরের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। ধুলো বালি কিংবা মাছি তাড়ানোয় ঝাড়ন হিসাবে চামর ব্যবহারের কথা নাইবা বললাম। তবে “মুশকিল আসান” দরবেশ বাবার হাতে চামর দোলানো কিন্তু এখনো চোখে ভাসে। প্রেমে হতাশ নায়িকা দরবেশ বাবার সামনে পড়ে গেলে, চামরের হালকা পরশেই “প্রবলেম সলভ”। মেডিকেল সাইন্স ফেল করলেও, সালমান খানের ভাঙা করোটিও চামরের কোমল পরশে মেরামত হয়ে যায়! কি মনে পড়ে? গায়ে কালো জোব্বা, গলায় টুকরো হাড়ের অথবা কাঠের মারবেলের মালা আর চামর হাতে চক্ষু মুদীত দরবেশ বাবা হাজির তো সব মুসকিল আসান…
প্রাচীন কাল থেকেই চীন, জাপান কিংবা গ্রীক রোমান’দের যুগেও হাতপাখার চলন ছিলো। তা প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে থেকেই। কোথাও পশুর চামড়া কিংবা গাছের পাতা দিয়ে বানানো, যার হাতল হিসেবে ব্যবহার হতো গাছের ডাল কিংবা পশুর হাড়। সেসব পাখা ভাঁজ করা যেতো না। ফোল্ডিং বা ভাঁজ করা পাখার পত্তন কিন্তু চীন জাপানিদের হাতে । আর এদেশে আগমন ইউরোপীয় বণিক’দের হাত ধরে আঠারো শতকে। হাতির দাঁত, সোনা রুপোর পাত লাগানো মনি মুক্তো খোঁচিত সেসব পাখা শোভা পেতো রাজ পরিবারে কিংবা অভিজাত মহিলা’দের হাতে। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী এদেশ দখলের পর রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইংরেজরা এদেশে পাড়ি জমান। উচ্চ বেতনে কোম্পানির চাকরি নয়তো তেজারতিতে দ্রুত কাঁচাটাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন মশগুল সাহেবান শুরুতেই এদেশের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় নাকাল হয়ে পড়েন। ঘন ঘন পোশাক বদল আর জল ছিটিয়ে গরম তাড়ানোই ছিলো উপায়। আর নয়তো ভরসা “গরম কালের প্রাণের সখা’ বড়সড় হাত পাখা। সেসব পাখার হাতল প্রায় তিন-চার ফুট লম্বা, আর প্রান্তে মখমলের ঝালর লাগানো। মাটিতে ভর দিয়ে খাড়া করতে হতো সে পাখা। সাহেব’দের গরম তাড়াতে বিশাল পাখা হাতে নিয়োজিত থাকতো পাখাল বা পাখাওয়ালা। (ছবি দ্রষ্টব্য)। কিন্তু এভাবে সারাক্ষণ পাখা নিয়ে কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকাতে ক্ষুন্ন হতো প্রাইভেসি, বিশেষ করে মেমসাহেব’ দের! চাপা থাকতো না অন্দর মহলের সন্দেশা। ঘরের কথা পরে জেনে যেতো। তাই সাহেবদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠে মোগলদের মাঝে কম জনপ্রিয় পাঙ্খার ব্যবহার। অষ্টম শতকে আরব দেশে দড়িতে টানা পাঙ্খা ব্যবহার হতো। আর তার এদেশ আগমন পর্তুগিজ’দের হাত দিয়ে। গুমোট বাতাস সরিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে শীতল হাওয়ার পরস দিতে সক্ষম পাঙ্খা।
সিলিং থেকে ঝোলানো পাঙ্খা ৮/১০ ফিট লম্বা, কখনো কখনো তা ২০/ ৩০ ফিট লম্বাও হতো। হাল্কা কাঠের ফ্রেমের উপর নকশি কাপড় মুড়ে প্রান্তে লাগানো হতো মখমলি ঝালর। সিলিং এ ৩/৪ টিকে হুকের সাথে বাহারী দড়ির সাহায্যে তা ঝুলানো হতো। একটি লম্বা দড়ি পাঙ্খার বডিতে সংযুক্ত করে তা দুপাশের দেয়ালে লাগানো চাকা সংযুক্ত করা হতো, যেন পাঙ্খাটা দুপাশেই নাড়ানো যায়। আর সেই দড়ি দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে ঘরের বাইরে পৌঁছত। দড়ির সে প্রান্ত ধরে টানলে পাঙ্খা টানের দিকে আসতো, আর দড়ি ছেড়ে দিলে তা আগের অবস্থানে ফিরে যেতো। এতে কক্ষের ভেতরে বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি হতো। দড়ির প্রান্ত টানাটানি করার লোকদের বলা হতো পাঙ্খা -বরদার বা পাঙ্খা ওয়ালা। এরা বিরামহীন ভাবে দাঁড়িয়ে, বসে কখনো শুয়ে পাঙ্খা চালিয়ে ফিরিঙ্গি’ দের আয়েশ নিশ্চিত করতো ( ছবি দ্রষ্টব্য)। আঠারো শতকে সারাদিন পাঙ্খা চালানোর মাইনে ছিলো তিন আনা। রাতের জন্য ও একই হারে মাইনে দেয়া হতো।
উইকিপিডিয়ায় কিছু মজার তথ্য ও পেলাম, যেমন দড়ির টানে পাঙ্খা জোরে আসার কারনে বাতাসের বেগ বেশি থাকতো আর ছেড়ে দিলে তা অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে আগের অবস্থানে ফিরে যেতো। ফলে বাতাসের গতিও কিছুটা কম থাকতো। ফিরিঙ্গিরা বেশী বাতাসের পাশটাকে বলতো “বোম্বাই সাইড” কম বাতাসের পাশটা “বেঙ্গল সাইড”। ভালো কিছু হলেই আমরা যেমন নামের আগে বোম্বাই যোগ করি (বোম্বাই লিচু, বোম্বাই মরিচ, বোম্বাই…)। ফিরিঙ্গী বিদ্যা ভালোই রপ্ত করেছো বাঙালি! (এহেন নামকরনের নেপথ্য কারন হচ্ছে, তৎকালিন ভারতের পশ্চিম উপকূলে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসা মৌসুমি বায়ু প্রচন্ড জোরে আছড়ে পড়তো আর বেঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছাতে সে বায়ুর গতিবেগ অনেকটা কমে যেতো, সে কারনে বেশি গতির পাশটা বোম্বাই আর কম গতির পাশ বাংলা সাইড।
পাঙ্খা-বরদার নিয়োগের ক্ষেত্রে বংশ পরম্পরায় প্রাধান্য দেয়া হতো “ঠসা” দের। কারন “ প্রাইভেসি “! অন্তঃপুর থেকে পাখালদের বাইরে পাঠানোয় বন্ধ হয়ে যায় দেখে ফেলার বিষয়। তারপর কানে খাটো’ পাঙ্খা-বরদার কামরার বাহির থেকে যদি কম শুনে তবে তো সাহেবি মর্যাদা অক্ষুণ্ণই রয়ে যাবে।
দিনের পর দিন, পাঙ্খার রশি টেনে টেনে ওরা হয়ে যেতো ভাবলেশহীন। অন্তঃপুরের হৈ-হুল্লোড়, হাসি কান্না কোন কিছু তেই থাকত না কোন প্রতিক্রিয়া। ঠিক যেমনটি আমরা হুমায়ুন আহমেদের “অয়োময়” নাটকে মির্জা বাড়ির পাঙ্খাওয়ালা কিংবা ঘেটুপুত্র কমলার কান্না শুনেও নির্লিপ্ত পাখালকে দেখেছি …যার একমাত্র কাজ কোন কিছু না দেখে, না শুনে শুধু সাহেবের জন্য মোলায়েম ঠান্ডা হাওয়ার জোগান দেয়া…
একসময়, শতবর্ষব্যাপি চলমান বিত্তবান শ্রেণির শৌখিনতার বিদায় ঘন্টা বাজে ১৮৯৯ সালে বাজারে বৈদ্যুতিক পাখার প্রচলন হলে, অবসান ঘটে নিকৃষ্টতর এক পেশার…
Attn: Reza Rahman, Ifteqhar Hussain Khan
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক ✍হাসান হাফিজুর রহমান।।