ডক্টর অফ ফিলোসফি (Doctor of Philosophy, Ph.D) একটি উচ্চ স্তরের শিক্ষাগত ডিগ্রী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য স্নাতক উত্তীর্ণ গবেষককে তার গবেষণা কর্মের জন্য এই ডিগ্রি প্রদান করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণত একজন গবেষককে গবেষণার বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন অধ্যাপকের অধীনে গবেষণা চালাতে হয়। PhD ডিগ্রির মধ্যে অনেক লুকানো বিষয় থাকে যাতে বোঝা বা শেখার দরকার অনেক কিছু থাকে। সাধারনত নতুন গবেষনা এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করা যা আগে কখনো করা হয়নি এসব বিষয় পিএইচডি অন্যতম চাহিদা। কোনো গবেষক এই চাহিদা পূরণ না করতে পারলে তাকে সাধারনত Phd ডিগ্রী প্রদান করা হয় না। যদি কোনো ব্যক্তি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তাহলে তার নামের আগে Dr. উপাধিটি যোগ করা হয়।
ইংরেজি Doctor (ডক্টর) শব্দটি মূলত ল্যাটিন ভাষা হতে আগত একটি শব্দ। এর প্রকৃত অর্থ হলো ‘শিক্ষক’ বা ‘প্রশিক্ষক’। মধ্যযুগের দিকে, ইউরোপে যারা ল্যাটিন ভাষা পড়াতো, তাদের একটি লাইসেন্স লাগতো, যার নাম ছিলো Licentia Docendi, এবং এই লাইসেন্টিয়াএ ডোসেন্ডির ইংরেজি অনুবাদ হলো License to Teach, অর্থাৎ শেখানোর লাইসেন্স। এই লাইসেন্সটিকেই ডাকা হতো Doctoratus, যার ইংরেজি হলো Doctorate, এবং এ লাইসেন্স যার থাকতো, তাকে বলা হতো ডক্টর, এবং ডক্টর মানে হলো শিক্ষক! তখনকার দিনে ডক্টর ছিলেন চার্চের পাদ্রীরা, যারা বাইবেল পড়াতেন ও ব্যাখ্যা করতেন। চার্চের অনুমতি ছাড়া কেউ ডক্টরেট ডিগ্রি বা শেখানোর লাইসেন্স পেতেন না। কিন্তু খ্রিস্টানদের পোপ, ১২১৩ সালে ঘোষণা করেন যে, আজ থেকে চার্চের পাশাপাশি ফ্রান্সের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ও শেখানোর লাইসেন্স বা ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারবে। এই ঘোষণার আগেও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাথোলিক চার্চের অনুমতি নিয়ে কিছু ছাত্রকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। কিথ এলান, তাঁর ‘Changing doctoral degrees: an international perspective’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, পৃথিবীর প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রিটি দেয়া হয় ১১৫০ সালের দিকে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে।
আজ থেকে হাজার বছর আগে খ্রিস্টানদের এই ডক্টরেট ডিগ্রির মতো আরেকটি ডক্টরেট ডিগ্রি মুসলিমদেরও ছিলো। নাম ছিলো ইযাজাহ। ডক্টরেট দেয়া হতো খ্রিস্টানদের চার্চ থেকে, আর ইযাজাহ দেয়া হতো মুসলিমদের মাদ্রাসা থেকে। কিন্তু দুটিরই অর্থ ছিলো শেখানোর লাইসেন্স। মোদ্দাকথা যাদের ডক্টরেট ও ইযাজাহ আছে, তারাই সমাজে শিক্ষকতা করতে পারতেন। তবে অধ্যাপক জর্জ মাকদাইসির মতে, ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটেছে মুসলিমদের ইযাজাহ ডিগ্রির অনুকরণে। এ কথা তিনি তাঁর ‘Scholasticism and Humanism in Classical Islam and the Christian West’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। মাকদাইসি ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সতেরো শতকের দিকে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ডক্টরেট ডিগ্রি বা শিক্ষকতার লাইসেন্সের একটি নাম দিলো ‘Doctorate of Philosophy’ বা PhD (Philosophiae Doctor), এবং অনেকেই এই ‘Philosophy’ শব্দের অর্থ করে থাকে দর্শন! কিন্তু এই ফিলোসোফি সেই ফিলোসোফি নয়। ডক্টরেট অব ফিলোসোফিতে যে-ফিলোসোফি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা মূলত গ্রীক ভাষায় শব্দটির মূল অর্থকে নির্দেশ করে। অর্থটি হলো: Love of Wisdom বা জ্ঞানের প্রতি মোহ। অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, ও পদপদবী নয়, যে-ব্যক্তির জ্ঞানের প্রতি মোহ জন্মেছে, সে-ব্যক্তিই পিএইচডি!
ফিলোসোফি শব্দটি ব্যবহারের পেছনে অন্য কারণও আছে। ইউরোপে তখন ইতিহাস, গণিত, দর্শন, সামাজিক বিজ্ঞান, ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সকল বিষয়কেই একত্রে ফিলোসোফি বলা হতো, এবং কলা অনুষদ বা ‘ফ্যাকাল্টি অব লিবারেল আর্ট’, মূলত ‘ফ্যাকাল্টি অব ফিলোসোফি’ নামে পরিচিত ছিলো। এজন্য কেউ দর্শনে ডক্টরেট না করলেও, তার ডক্টরেট ডিগ্রিকে ‘ডক্টরেট অব ফিলোসোফি’ বলা হতো। সংক্ষেপে তারা এটিকে লিখতো Dr. Phil. তবে কিছু কিছু জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়, পরবর্তীতে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ডক্টরেটগুলিকে দর্শনের ডক্টরেট থেকে আলাদা করার জন্য ‘Doctor Rerum Naturalium’ বা ‘Doctor of Natural Sciences’ শব্দগুচ্ছটির ব্যবহার শুরু করে। এটিকে সংক্ষেপে লেখা হয় Dr. rer. nat.
এবং একইভাবে, কেউ সামাজিক বিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট করলে, লেখা হয় Dr. rer. pol., আইন বিষয়ে করলে, লেখা হয় Dr. jur., ইত্যাদি। সুতরাং জার্মানিতে যা Dr. Phil বা Dr. rer. nat. বা Dr. jur., ইংরেজি বিশ্বে তা PhD বা DPhil; বিষয় যাই হোক না কেন।
ঊনিশ শতকের দিকে, আমেরিকায় আরেক ধরণের ডক্টরেট ডিগ্রির প্রচলন ঘটে। এগুলোকে বলা হয় পেশাদার বা প্রোফেশোনাল বা ভোকেশোনাল ডক্টরেট ডিগ্রি। এদের একটি হলো ‘Doctor of Medicine’, যার ল্যাটিন নাম ‘Medicinae Doctor’, সংক্ষেপে লেখা হয় M.D., এবং আরেকটি হলো ‘Juris Doctor’ বা J.D.।
এমডি হলো চিকিৎসা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, যা আমেরিকানরা ধার করেছে মূলত স্কটল্যান্ড থেকে, এবং জেডি হলো আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি। এ ডিগ্রিগুলো আমাদের এমবিবিএস ও এলএলবির সমান, কিন্তু দুটোই ডক্টরেট ডিগ্রি। এই অনেক ঘরানার ডক্টরেট ডিগ্রির একটি হলো গবেষণামুখী ডক্টরেট বা রিসার্চ-ডক্টরেট, এবং পিএইচডি বলতে গড়-মানুষেরা এখন এটিকেই বোঝে। গড়-মানুষদের ধারণা, এটিই একমাত্র পিএইচডি এবং এ ডিগ্রি যার আছে তিনি সমাজে জ্ঞান চর্চায় প্রভাবশালী।
সূত্র : বিভিন্ন সোর্স থেকে সংগ্রহ ও পরিমার্জিত করেছেন সাতক্ষীরার নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল মোমিন।