পুরোনো ঢাকায় ঘুরতে যাবার কথা মনে এলেই লালবাগকেল্লা আর আহসান মঞ্জিলের কথা সবার আগে মনে আসে।কিন্তু এ দুই নিদর্শন ছাড়াও আরও অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে যা শত শত বছরের ইতিহাসকে লালন করছে। তেমনি এক নিদর্শন হলো ঢাকার আর্মানিটোলায় অবস্থিত আর্মেনিয়ান চার্চ যা তিন শত বছর পুর্বে এদেশে আগত আর্মেনিয়ান বসতির সাক্ষ্য বহন করছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকাল ১১.৩০ এর দিকে কল্যানপুর থেকে নিজ গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। ওখানে যখন পৌছাই তখন জুম্মার আযান দিচ্ছিল। গুগল ম্যাপ দেখার পরও কিছুটা খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছে। আর্মানিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা নিয়ে আসতে হয়।
দরজায় টোকা দিতেই গার্ড বিশাল দরজা খুলে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর স্যানিটাইজার আর একটা রেজিস্ট্রার খাতা এগিয়ে দিলেন যেখানে নাম আর ঠিকানা লিখতে হলো। এখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।সামনে এগুতেই চোখে পরলো সারি সারি আয়তাকার মার্বেল পাথরের এপিটাফ যুক্ত আর্মেনিয়দের কবর। এপিটাফে ইংরেজি ও আর্মেনিয় ভাষায় তাদের নাম পরিচয় আর কাব্য ঢঙে লেখা দু একটা লাইন।প্রথম কবরটা ছিল ডেভিড ফ্রিদোভিচ মেলিক বাগলারের যার এপিটাফে ইংরেজিতে লেখা চরণের অনুবাদ হলো ” বাড়ি ফিরে যাও আমার সন্তানেরা,আর তোমাদের অশ্রুকে নিবৃত্ত কর। যীশুর পুনরাগমন অবধি আমাকে এখানে থাকতেই হবে।” আমি এপিটাফটার ছবি নিচ্ছিলাম আর অমনি গার্ড ছুটে এসে জানালো শুধু কবরের ছবি তোলা নিষেধ। তারপর কবরগুলোর পাশ দিয়ে কিছুটা এগুনোর পর দেখা মিলল মার্বেল পাথরের তৈরি মাদার মেরীর একটি ভাষ্কর্য। তার নিচে ক্যাটচিক এভেটিক থমাসের কবর যিনি ছিলেন এই ভূমির মালিক এবং যিনি ১৭৬৮ সালে চার্চের জন্য এই ভূমি দান করেন। তার স্ত্রী এই মূর্তিটি কোলকাতা থেকে আনিয়েছিলেন। কবরের উপর এরকম ভাষ্কর্যকে ওবেলিক্স বলে। ভাষ্কর্যটির একটি হাত ভাঙা ছিল আর এর নীচে এপিটাফে লেখা ছিল ” A fond wife’s tribute to her deeply mourned and best of husbands” ভাষ্কর্যটির বাম দিকেই চার্চের অবস্থান। পুরো আঙিনা জুড়েই কবর।কিছু আছে মাটি থেকে ৬/৭ ইঞ্চি উচুতে। আর চার্চের দরজার সামনে ফ্লোরের সমান কিছু মার্বেল পাথরের এপিটাফের মত।চার্চে ঢুকতে হলে ওগুলোর উপর দিয়ে হেটে যেতে হবে।বুঝতে পারছিলাম না ওগুলো কবর কি না। যদি তাই হয় তবে ওর উপর হাটবো কিকরে।একজন লোক এসে ওগুলোর উপর হেটে গিয়ে দরজা খুলে আমাদের ঢুকতে দিল। বুঝলাম ওগুলো কবর না।
চার্চের ভিতরের প্রেয়ার হলটা বিশাল বড়।দুপাশে চেয়ারগুলো সারি করে রাখা। উপরেও বসার ব্যবস্থা আছে। একটা বিষয়ে একটু অবাক হলাম যে প্রেয়ার হল এমনকি চার্চের কোথাও যীশুর ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় কোন মূর্তি দেখলাম না। তবে তার ছবি রাখা আছে। হলে ঢুকতেই বা দিকে সর্পিলাকার একটা কাঠের সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে।ওটা দিয়ে দোতলার প্রেয়ার বারান্দায় যেতে হয়। ওখানে আগে মহিলাদের বসার স্থান ছিল। উপরে যাওয়া নিষেধ।
আর্মেনিয়া দেশটির অবস্থান ইরান ও তুরস্কের কাছে। মূলত ব্যবসার উদ্দেশ্যে তারা এদেশে আসতে শুরু করে। অনুমান করা হয় মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় তারা এদেশে আসে এবং ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে তারা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। এ এলাকায় তাদের অনেক প্রভাব ছিলো বলে এর নাম আর্মানিটোলা রাখা হয়। ১৭৮১ সালে একজন আর্মেনিয় জমিদার নিকোলাস পোগজ এই গীর্জাটি নির্মান করেন। জানা যায়, প্রায় ৩৫০ টির বেশি কবর আছে এই চার্চ প্রাঙ্গণে।চার্চের উপরের টাওয়ারে রয়েছে এক বিশালাকার ঘন্টা যার ধ্বনিতে একসময় পুরো এলাকা জেগে উঠতো। বর্তমানে এটি অকেজো। চার্চ থেকে বেরিয়ে বা দিকে গেলে একটা বিরাট বারন্দা যার মেঝেতে আছে পুরোনো কিছু কবর যা মেঝের সাথে লাগানো আর পাশের আঙিনা পুরোটাই কবর। ডানদিকে একটা বাংলো প্যাটার্নের বাড়িতে এখানকার স্টাফরা থাকেন।
যখন বেড়িয়ে এলাম বেলা তখন ১টা। গন্তব্য তখন তারা মসজিদ, বিউটি বোর্ডিং, রোজ গার্ডেন ও বলদা গার্ডেন।কিন্তু তার আগে পুরোনো ঢাকার খাবার হাতছানি দিচ্ছিল। সাত রওজা মসজিদের কাছেই সুলতান’স ডাইন, কোলকাতা বিরিয়ানি হাউজ, শাহী মোগল সহ আরও অনেক বিখ্যাত খাবারের দোকান। আমরা বসেছিলাম শাহী মোগল নামের একটা রেস্টুরেন্টে। ওদের প্ল্যাটার গুলো ২৫০/২৮০ থেকে শুরু।আমরা নিয়েছিলাম জাফরান পোলাও, মুরগী মোসাল্লাম আর মাটন রেজালা।২৮০ টাকা করে প্রতি প্লেট। ড্রিংস বা বোরহানি নিলে আলাদা চার্জ দিতে হবে। খাবার ভীষণ মজা ছিলো।
পুরোনো ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন যা ট্যুরিজমে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।আমরা এর পরিবেশকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করি।
ভ্রমণকাহিনী
লেখিকাঃ জাকিয়া নূর মিতু
সহকারী অধ্যাপক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।