রাজ্য আক্রান্ত, শত্রুসেনার বিশাল বহর প্রাসাদ ফটকে, অবরুদ্ধ রাজ প্রাসাদ। শত্রুসেনা মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট লোকবল নেই, রাজন্য বর্গের কপালে চিন্তার ভাঁজ, কিন্তু মোটেও বিচলিত নন রাজা মশায়। কৌশলে শত্রুজয় করবেন তিনি, প্রয়োগ করলেন ষোল বছর ধরে তিলে তিলে গড়া অস্ত্র….
রাজধানীর উপকন্ঠে অপেক্ষমান ছাউনিতে জয়ের নেশায় মত্ত যুদ্ধবাজ শত্রুরাজা সেনাপতি ও পারিষদবর্গ নিয়ে কৌশল খুঁজতে ব্যস্ত। এ সময় বিশ্বস্থ চর রাজামশায়ের কানে কানে কিছু একটা জানালো। বৈঠক ছেড়ে অস্থির চিত্তে খাস তাঁবুর দিকে পা বাড়ালেন যুদ্ধক্লান্ত রাজা। তলব হলো ছাউনির বাইরের বীণাবাদক অপরুপাকে, এক্কেবারে খাস তাঁবুতে…
শুধু সুন্দরীই নয়, নৃত্যগীতেও পটিয়সী, বীনা বাদনে নিপুণা… রাজার চোখে চোখ রাখলো, বুঝে নিলো না বলা ভাষা, ধীরলয়ে এগিয়ে এলো লজ্জাবতী, যুদ্ধবাজ রাজার চোখে ছড়ালো ভিন্ন আগুন, প্রবর আবেগে কাছে টানলেন, ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই, মুহুর্তে লুটিয়ে পড়লেন রাজা। তা দেখে সেনাপতি কিংবা পারিষদবর্গের কেউ বিচলিত নন, মনে হলো উত্তেজনার আধিক্যে হুস হারিয়েছেন রাজামশায়। সে আগুণে তারাও সংক্রমিত হলো, লাবন্যময়ীর আলিঙ্গন পেতে ব্যস্ত সবাই, কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি তাদের মাঝে। পলকে সে-খবর রটে গেলো রাজধানীতে, অবরুদ্ধ নগর থেকে বেরিয়ে এলো রাজকীয় বাহিনী। নেতৃত্বহীন শত্রুঘাঁটি প্রতিঘাতে লন্ডভন্ড…
কিছুক্ষণ আগের প্রমোদ-শিবির পরিণত শ্মশানে। শবের ভিড়ে দাঁড়িয়ে সেই মোহিনী, মুখে রহস্যের হাঁসি। বীরের বেশে প্রাসাদে আনা হলো বিজয়লক্ষ্মীকে। শত্রুমুক্ত হয়েছে দেশ, রাজা নিশ্চিন্ত, অস্ত্রের ধার পরীক্ষা হলো, হাতিয়ার যোগ্যতা প্রমান করেছে। আর ভয় নেই রাজার, এবার আসুক না মোঙ্গল কিংবা আলেকজান্ডার… ভারত প্রস্তুত…
অব্যর্থ এই হাতিয়ারের নাম বিষকন্যা…
সু-প্রাচীন কাল থেকে বিনাযুদ্ধে শত্রুবিনাশে ভারতীয় রাজা-মহারাজাদের অব্যর্থ এক রীতি।
কল্কিপুরাণ, শুকসপ্ততি এবং চানক্যের অর্থশাস্ত্রে বারবার এসেছে বিষকন্যার কথা। তখনকার রীতি অনুযায়ী ভাগ্য গণনায় যদি দেখা যেত কোন সুন্দরীর ভাগ্যে বৈধব্য যোগ আছে, তবে তাকে পরিবার থেকে আলাদা করে দেয়া হতো নৃত্য গীত বীণা বাদন আর কাম ছলাকলার বিশেষ প্রশিক্ষণ, পথ্য ছিলো সহনীয় মাত্রার বিষ মেশানো খাবার, ধীরে ধীরে বিষের পরিমান বাড়লেও তাদের শরীরে প্রভাব পড়তো না। বিষধর ললনা’দের শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত হতো গরল। তাদের সম্ভোগ, চুম্বন কিংবা স্পর্শে ছিলো অনিবার্য মৃত্যু.. ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Mithridatism
খ্রিষ্টপূর্ব ভারতবর্ষীয় এই রীতি গোপন থাকে নি, চাওড় হয়ে ছিলো প্রাচিন গ্রিক, রোম সাম্রাজ্যেও। বার্ধক্যবশত গুরু এরিষ্টটল শিষ্য আলেকজান্ডারের বিজয় অভিযানে সঙ্গী হতে না পারলেও সুন্দরী বিষকন্যা সম্পর্কে সতর্ক করতে ভুলেননি মহাবীরকে। এরিষ্টটল রচিত Secretum Secretorum, De Secretis Secretorum, De regimine Principiem পুঁথিতে রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, দেহবিদ্যা, নৈতিকতার পাশাপাশি বাদ যায় নি বিষকন্যার কথাও। তারপরেও মহাবীর আলেকজান্ডারের তাঁবুতে পৌছেছিলো প্রাচিন ভারতীয় বিষকন্যা…
(ক্রমশঃ)
লেখকঃ বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান।